কোন ব্যক্তির ওজনকে কেজিতে পরিমাপ করে, তার মিটারে পরিমাপ করা উচ্চতার বর্গ দিয়ে ভাগ
করলে তাকে বডি মেস ইনডেক্স (বিএমআই) বলে। এটি কম খরচে, কোন ঝামেলা ছাড়াই
বয়স অনুসারে কেউ ওভার ওয়েট, আন্ডার ওয়েট অথবা পারফেক্ট ওয়েটে আছে কি না, তা নির্ণয় করার সবচেয়ে উপযোগী পন্থা।
বিএমআই শরীরের ওজন মাপে না, পরিবর্তে এটি আপনার বাচ্চার শরীরে কোষের পরিমাণ (মাসল, ফ্যাট এবং হাড়) নির্ণয় করে। বিএমআই শরীরের ফ্যাট সরাসরি পরিমাপ করে না, কিন্তু
এটি সরাসরি শরীরের সাথে সম্পর্কিত ফ্যাটের উৎস গুলির পরিমাপ করে। আপনার সন্তান ওভার
ওয়েট, আন্ডার ওয়েট নাকি বয়সের তুলনায় তার সঠিক ওজন আছে- তা নিশ্চিত করার জন্য
বিএমআই সবচেয়ে ভালো পদ্ধতি।
ওজন
= ——————–
(উচ্চতা মিটারে) 2
বি এম আই (BMI) এর প্রয়োজনীয়তা?
BMI নির্ণয়ের মাধ্যমে আপনি সহজে আপনার বাচ্চার ওজন নিয়ন্ত্রণে রাখতে পারেন। আমরা জানি, স্বাভাবিক এর তুলনায় কম বা বেশি ওজন উভয়ই স্বাস্থ্যের জন্য ক্ষতিকর। বাচ্চার ওজন যদি স্বাভাবিক এর তুলনায় বেশি থাকে, তবে ওবিসিটি, ডায়াবেটিস, হৃদরোগ সহ অন্যান্য জটিল রোগে আক্রান্ত হওয়ার সম্ভাবনা ও বেশি থাকবে। অন্যদিকে স্বাভাবিক এর তুলনায় কম ওজন রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা কমিয়ে দেয়। তাই বলা যায়, সুস্বাস্থ্যের জন্য তথা সুন্দর ভবিষ্যৎ এর জন্য আমাদের সকলেরই ওজন নিয়ন্ত্রণ করা প্রয়োজন।
শিশুদের বিএমআই ক্যালকুলেশন:
প্রাপ্ত বয়স্কদের তুলনায় শিশুদের খুব তাড়াতাড়ি শারীরিক পরিবর্তন দেখা দেয়। তাই, তাদের বিএমআই উচ্চতা ও ওজন অনুসারে নির্ণয় করা হয়। এই পরিমাপটা z-স্কোর অনুসারে নির্ণয় করা হয়, যেখানে একই লিঙ্গের একই বয়সের শিশুদের বিএমআই পরিমাপ করে তাদের স্ট্যান্ডার্ড মান নির্ণয় করা হয়। এই পদ্ধতিতে ২ বছর বয়স থেকে ১৯ বছর বয়স পর্যন্ত BMI মাপা যাবে।
কাট অফ -এর ইন্টারপ্রিটেশন
ওভার ওয়েট: > +১ z-স্কোর (বয়স ১৯ -এর জন্য বিএমআই ২৫ কেজি/মি2 )
ওবিসিটি: > +২ z-স্কোর (বয়স ১৯ -এর জন্য বিএমআই ৩০ কেজি/মি2 )
থিননেস (আন্ডারনিউট্রিশন): < -২ z-স্কোর
সিভিয়ার থিননেস (আন্ডারনিউট্রিশন): < -৩ z-স্কোর
প্রাপ্ত বয়স্ক ও শিশুদের থিননেস অথবা আন্ডার নিউট্রিশন: এটা হয় যখন শক্তি, গ্রোথ অথবা ইমিউন সিস্টেমের জন্য প্রয়োজনীয় নিউট্রিশনের তুলনায় কম নিউট্রিশন গ্রহণ করা হয়।
আন্ডারনিউট্রিশনের কারণ (থিননেস)
আমরা আন্ডারনিউট্রিশনের কারণগুলোকে ইমিডিয়েট এবং আন্ডারলাইয়িং- এই দুইভাগে ভাগ করতে পারি।
ইমিডিয়েট কারণ:
*পুষ্টির প্রয়োজনীয়তা নিয়ে স্বল্প এবং সঠিক জ্ঞান না থাকা।
*পরিমানের তুলনায় কম খাবার খাওয়া কিংবা অনিয়মিত খাওয়া দাওয়া, নিয়মিত পুষ্টিকর খাবার না খাওয়া
*বিভিন্ন ধরণের রোগ যেমন ডায়রিয়া, শ্বাস প্রশ্বাসে সমস্যা বা কানের ইনফেকশন, হাম, ক্রিমি এবং অন্যান্য পরজীবীর আক্রমণ।
আন্ডারলাইয়িং কারণ:
*পরিবারের খাবার নিয়ে ইনসিকিউরিটি
*পরিবারের দুর্বল সদস্যদের পর্যাপ্ত যত্ন না নেওয়া
*অস্বাস্থ্যকর জীবনযাপন
*পর্যাপ্ত স্বাস্থ্যসেবা না থাকা
কীভাবে নিশ্চিত করবেন সন্তানের নিউট্রিশন?
শিশুর বয়স ০-৬ মাস
নবজাতক:
*আমবিলিক্যাল কর্ড কাটার দু’ মিনিট পূর্বে শিশু যেন সর্বোচ্চ পরিমাণ রক্ত পায়
*শিশু যেন জন্মের পরপরই এক ঘণ্টার ভিতর শাল দুধ পায় তা নিশ্চিত করতে হবে। শাল দুধ পুষ্টি সমৃদ্ধ এবং ইনফেকশন এর বিরুদ্ধে কাজ করে। তাই, প্রতি দু-তিন ঘণ্টা পরপরই তাকে শালদুধ দিতে হবে।
মায়ের বুকের দুধ শিশুর প্রয়োজনীয় পুষ্টি ও পানির ঘাটতি পূরণ করে, তাই ডাক্তাররা সকল মায়েদের প্রথম ছ’মাস শিশুকে শুধু বুকের দুধ খাওয়ানোর জন্য পরামর্শ দিয়ে থাকেন। বাবা- মা কে পরামর্শ দিতে হবে কেন এবং কিভাবে স্তন দানের সময় গর্ভধারণ এড়ানো সম্ভব। গর্ভধারণ বুকের দুধ নষ্ট করে না তবে মায়ের উপর অনেক নিউট্রেশনাল চাপ তৈরি করে।
শিশুর বয়স ৬ মাস থেকে ৫ বছর
পরিবার কে পরামর্শ:
*দু’ বছর বয়স না হওয়া পর্যন্ত বুকের দুধ ছোট শিশুদের জন্য খুবই গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে।
*ছ’ মাস বয়স হওয়ার সাথে সাথে শিশুকে অন্যান্য খাবার দেওয়াও শুরু করতে হবে। এগুলো হওয়া উচিত:
-> পুষ্টি এবং শক্তির দিক থেকে পরিপূর্ণ
-> জাউয়ের পাশাপাশি খাবারে অবশ্যই পর্যাপ্ত পরিমাণে চিনাবাদাম,শিম, সবজি, ফল,এবং যখনই সম্ভব আমিষ জাতীয় খাবার যেমন মাছ, মাংস দিতে হবে।
-> একটা একটা করে শুরু করা।
-> খাবার যেন খুব বেশী গরম, লবণাক্ত অথবা মিষ্টি না হয়।
-> স্বাস্থ্যকর ভাবে খাবার তৈরি করা। প্রাণীজ দুধ অবশ্যই ফুটিয়ে নেওয়া।
-> খাবার যেন নরম এবং সহজ হয়।
-> ছোট শিশুদের তাদের প্রয়োজন অনুযায়ী ঘনঘন বুকের দুধ দেওয়া। ছ’ মাস বয়স থেকে দিনে দু- তিনবার খাবার দেওয়া একবছর বয়স হওয়ার সাথে সাথে তা বাড়িয়ে চার বার করা। মিষ্টি অথবা লবণাক্ত খাবার এড়িয়ে চলা।
পরিবারের মানুষদের শিশুদের খাবার খেতে উৎসাহিত করার পরামর্শ দেওয়া কিন্তু কখনও জোরপূর্বক খাবার না খাওয়ানো।
শিশুর ছ’ মাস বয়স থেকে পাঁচ বছর বয়স পর্যন্ত ভিটামিন-এ এর পরিপূরক খাবার দিয়ে যেতে হবে।
স্কুল- পড়ুয়া শিশু (বয়স ৫ বছর থেকে ১৯ বছর)
পরিবার কে পরামর্শ:
*শিশুর তিন বেলা খাবার প্রয়োজন – তা বিভিন্ন ধরণের পুষ্টিকর খাবারের সমন্বয়ে। শিশুরা একটিভ থাকবে, এবং কাজে মনযোগী হবে যদি তাদের সকালের নাস্তা, মধ্যান্হের খাবার অথবা নাস্তায় ঠিকমত পুষ্টিকর খাবার খায়।
*তরুণদের বয়ঃসন্ধির সময়টাতে প্রচুর পরিমাণে উচ্চ প্রোটিন, পুষ্টি সমৃদ্ধ খাবার প্রয়োজন।
সকল প্রাপ্ত বয়স্ক
পরিবারের বৃদ্ধ থেকে শুরু করে সবাইকে পরামর্শ দিয়ে সকলের পরিমিত খাবার নিশ্চিত করতে হবে:
* বিভিন্ন রকমের খাবার, বিশেষ করে চিনাবাদাম, মটরশুঁটি, শিম এবং বিভিন্ন রকমের ফল, শাক- সবজি খেতে হবে।
* আমিষ জাতীয় যেমন মাছ, মাংস এবং বিভিন্ন অঙ্গ (ইজি,কিডনি,গাটস) যদি সহজলভ্য হয়। ইনফেকশন, অপুষ্টি প্রতিরোধ করে
* খাবার খাওয়ার পূর্বে এবং টয়লেট ব্যবহার এর পর ছাই অথবা সাবান দিয়ে হাত পরিষ্কার করুণ।
প্রজননক্ষম বয়সী মহিলা:
পরামর্শ পরিবারের প্রতি:
*মহিলা এবং মেয়ে সবারই পুষ্টিকর খাবার প্রয়োজন সবসময় গর্ভধারণ এর সময়ও তবেই তারা পুনরায় পুষ্টির চাহিদা পূরণ করতে পারবে।
*গর্ভবতী এবং স্তন দানকারী মায়ের প্রয়োজন বেশী আয়রন সমৃদ্ধ খাবার। যেমন- মাংস লিভার-এবং অন্যান্য অঙ্গের মাংস, পোল্ট্রি, মাছ।
*মহিলাদের প্রয়োজন অধিক শারীরিক এবং মানসিক সাপোর্ট গর্ভধারণের সময় বিশেষকরে তারা যদি কম বয়সী হয়।
*খুব ভালো হয় যদি গর্ভধারণ এর মাঝে দু- তিন বছর সময় নেওয়া হয় এতে শরীরে পুষ্টির ঘাটতি পূরণ হয়ে যায়।
*গর্ভবতী নারীদের উৎসাহ দেয়া কেন তাদের আয়রন এবং ফলিক এসিডের পরিপূরক দরকার।
যখন প্রয়োজনের তুলনায় বেশী ক্যালরি গ্রহণ করা হয়, অথবা যতোটুকু গ্রহণ করা হয় তা শরীরে থেকে যায় তখন অতিরিক্ত ওজন এবং স্থূলতা সময়ের সাথে সাথে বৃদ্ধি পায়। এ ধরনের শক্তির ভারসাম্যহীনতা আমাদের শরীরে চর্বি তৈরি করে। এভাবেই শরীরে চর্বি-কোষের সৃষ্টি হয়। স্থূলতা খুবই গুরুত্বপূর্ণ একটি শারীরিক সমস্যা যা বিভিন্ন রকমের রোগের কারণ হয় যেমন- হাই ব্লাড প্রেশার, হাই ব্লাড কোলেস্টেরল,ক্যান্সার এবং নিদ্রাহীনতা।
ওভার ওয়েট এবং ওবিসিটি
বিভিন্ন কারণে ওভার ওয়েট এবং ওবিসিটি তৈরি হয়। এর মাঝে ডায়েট, অপর্যাপ্ত শারীরিক কার্যকলাপ, পরিবেশ, জিনগত বৈশিষ্ট্য অন্তর্গত। নীচে এসব ফ্যাক্টর নিয়ে বিস্তারিত আলোচনা করা হল:
১. স্বল্প মূল্যের খাবারের সহজলভ্যতা: উচ্চ ফ্যাট, চিনি ও লবণ যুক্ত খাবার
২. যাতায়াত ব্যবস্থার উন্নতি ও সেডেন্টারি লাইফ-স্টাইলের জন্য শারীরিক পরিশ্রম কমে যাওয়া ফলে ওজন বেড়ে যাচ্ছে।
৩. জিনগত বৈশিষ্ট্য: বিভিন্ন ধরণের জিনগত বৈশিষ্ট্য ওভার-ওয়েট ও ওবিসিটির সাথে সম্পৃক্ত যেমন: পরাদের ওইলি সিন্ড্রোম, বারডেট-বাইডেল সিন্ড্রোম, অ্যালস্ট্রোম সিন্ড্রোম, কোহেন সিন্ড্রোম
৪. এন্ডোক্রিন ডিসঅর্ডার: এন্ডোক্রিন সিস্টেম হরমোন উৎপাদন করে যা শরীরের শক্তির সমতা রাখরে সাহায্য করে। এই ডিসঅর্ডারটি ব্যালেন্সটি নষ্ট করে ওভারওয়েট ও ওবিসিটির সমস্যা তৈরি করে।
৫. ওষুধ যেমন অ্যান্টিসাইকোটিক্স, অ্যান্টিডিপ্রেসেন্ট, অ্যানয়িপিলেপ্টিক্স এবং অ্যান্টি হাইপারগ্লাইকেমিক্স ওজন বৃদ্ধি করে ওভারওইয়েট ও ওবিসিটির সমস্যা সৃষ্টি করতে পারে।
৬. সহজে অস্বাস্থ্যকর ফাস্টফুড পাওয়ার পরিবেশ তৈরি করার পাশাপাশি বিনোদনের স্থান যেমন পার্কের স্বল্পতা, যা হাঁটাহাঁটির অভ্যাসকে নিরুৎসাহিত করে।
৭. বিভিন্ন ধরণের রাসায়নিক দ্রব্যে যেমন ওবিসজিনস এর সংস্পর্শে আসলে হরমোনের পরিবর্তন হয়ে শরীরের ফ্যাট টিস্যু বৃদ্ধি পায়।
৮. স্ট্রেস, ইমোশনাল ফ্যাক্টর এবং খারাপ ঘুম: বিভিন্ন গবেষণায় দেখা গিয়েছে, যারা কম ঘুমায় তাদের ওভার ওয়েট অথবা ওবিসিটির সমস্যা দেখা দেয়।এটি ঘুম নিয়ন্ত্রণের জন্য নির্গত হরমোন ও শরীরের শক্তির ব্যবহারের জন্য হয়।
কীভাবে ওভার ওয়েট ও ওবিসিটি দূর করা যায়?
ওভার ওয়েট এবং ওবিসিটির পাশাপাশি এদের সম্পর্কিত রোগগুলোকে প্রতিরোধ করা যায়। হেলদি খাবার ও শারীরিক পরিশ্রমের মাধ্যমে ওভার ওয়েট ও ওবিসিটি দূর করা যায়, যার অভ্যাস গড়ে তোলার জন্য সাপোর্টিভ পরিবেশ ও সম্প্রদায় গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে।