শিশুর মেধা ও বুদ্ধির বিকাশ কয়েকটি ধাপে ঘটে। প্রতিটি ধাপেই আলাদা আলাদা পুষ্টি উপাদানের দরকার পরে। আর দেহ সে উপাদানগুলো গ্রহণ করা খাদ্যের মধ্যেই খুঁজে। দেহের বৃদ্ধির জন্য যেমন প্রোটিন, শর্করা ও অন্যান্য উপাদানের দরকার হয়, মস্তিষ্কেরও তেমন কিছু বিশেষ পুষ্টির চাহিদা থাকে। তাই এ সময়টুকুতে শুধু দেহের গঠনের জন্য খাবারে মনোযোগ দিলেই হবে না, খেয়াল রাখতে হবে যেন শিশুর মস্তিষ্কের প্রয়োজনীয় উপাদানগুলোও খাবারের মধ্যে থাকে।
বেশ কিছু গবেষণা থেকে শিশুর বেড়ে উঠার সময় মস্তিষ্কের বৃদ্ধির জন্য গুরুত্বপূর্ণ কিছু পুষ্টি উপাদানের সরাসরি ভূমিকা সম্পর্কে জানা গেছে। যদিও সব ধরণের পুষ্টিগুণই শিশুর জন্য দরকারী, কিছু বিশেষ উপাদান মেধার বিকাশের জন্য অপরিহার্য।
জিঙ্ক: জিঙ্কের অভাবের সাথে শিশুর মানসিক চাপ নিতে পারার ক্ষমতা কম থাকা, কোন কিছুতে বেশিক্ষণ মনোযোগ না রাখতে পারা, পড়াশোনায় দুর্বল হওয়া ইত্যাদির সম্পর্ক পাওয়া গেছে। মাংস, ডিম, বাদাম, সবুজ শাকসবজি, ডার্ক চকলেট ইত্যাদিতে প্রয়োজনীয় জিঙ্ক পাওয়া যায়।
আয়োডিন: ভ্রূণাবস্থা থেকেই শিশুর আয়োডিনের প্রয়োজন পড়ে। গর্ভবতী মায়ের শরীরে আয়োডিনের অভাবে থাইরক্সিন হরমোনের ঘাটতি হয়, ফলে শিশুও প্রয়োজনীয় থাইরক্সিন পায় না। আয়োডিনের অভাবে শিশুর বুদ্ধিপ্রতিবন্ধী হওয়ার ঝুঁকি বেড়ে যায় অনেকগুণে।
প্রতিদিনের খাবারের সাথে আয়োডিন যুক্ত লবণ গ্রহণ করলেই দেহের আয়োডিনের ঘাটতি মেটে। এ ছাড়া সামুদ্রিক মাছ, মাছের যকৃতের তেল যেমন কডলিভার, শার্ক লিভার অয়েল, সামুদ্রিক উদ্ভিদ এবং ছাগলের দুধে প্রচুর আয়োডিন পাওয়া যায়।
আয়রন: আয়রনের অভাবে অ্যানামিয়া বা রক্তশুণ্যতা হয়। আর রক্তশুণ্যতা শিশুর মানসিক সমস্যার কারণ হয়ে দাঁড়ায়। বুদ্ধিমত্তার দুর্বলতা, নিউরনের ক্ষতি ইত্যাদি সমস্যা যা মস্তিষ্কে চিরস্থায়ী ক্ষতি করে, এই আয়রনের অভাবেই তা হতে পারে। এছাড়া বেশ কিছু গবেষণায় দেখা গেছে, যেসব শিশুর দেহে আয়রনের ঘাটতি থাকে, তারা অপেক্ষাকৃত বেশি অমনোযোগী, সামাজিক মেলামেশায় দুর্বল ও ভীতির পরিমাণ বেশি থাকে।
বিভিন্ন লাল মাংস, কলিজা, ডিম, সামুদ্রিক মাছ, দই, খোসা সহ আলু, পালং ও লালশাক, পিনাট বাটার ইত্যাদি আয়রন সমৃদ্ধ খাবার খাওয়াতে হবে শিশুকে। পাশাপাশি দেহ যেন ঠিকভাবে আয়রন শোষণ করতে পারে, সেজন্য ভিটামিন সি খাবারের তালিকায় রাখতে হবে।
ভিটামিন বি-১২: ভিটামিন বি-১২’র অভাবে নবজাতকের মাঝে খিটখিটে স্বভাব, উদ্যমের অভাব, খাবারের প্রতি অনীহা, উদাসীনতা ইত্যাদি দেখা যায়। গর্ভকালীন সময়ে মায়ের খাবারে যথাযথ পরিমাণে এই ভিটামিন না থাকলে শিশুর মস্তিষ্কের বিকাশে এসব সমস্যা সৃষ্টি হয়। ডিম, দই, দুধ, পনির, মাছ-মাংস খেয়েই এ ঘাটতি মেটানো সম্ভব।
স্যাকারাইড: স্যাকারাইড জাতীয় গ্লুকোজের সাথে কগনিটিভ বা মস্তিষ্কের সম্পর্কের কথা গবেষণায় জানা গেছে। মানসিক প্রতিক্রিয়ার দ্রুতি বাড়ানো, স্মৃতিশক্তির বর্ধন ও বুদ্ধির বিকাশে এর ভূমিকা রয়েছে। শর্করা জাতীয় খাবার থেকে সহজেই এটি পাওয়া যায়।
ভিটামিন ই: কোন কিছু দেখে তা বুঝতে পারা ও মনে রাখার ক্ষমতা, ভাষাগত দক্ষতা ইত্যাদির উন্নতিতে প্রয়োজন পড়ে ভিটামিন ই। বিভিন্ন বাদাম, মাছের তেল ও বিভিন্ন উদ্ভিজ্জ তেলে থাকে প্রচুর ভিটামিন ই। গর্ভকালীন সময় থেকেই খাদ্যে ভিটামিন ই যেন থাকে সেদিকে নজর দেয়া উচিৎ।
মধু : স্বাস্থ্য সংক্রান্ত উপকারিতায় একটি উল্লেখ করার মত খাবার হচ্ছে মধু। সব রোগের নিরাময়এ মধু ব্যাবহার করতে বলা হয়। এতে রয়েছে নানা ধরনের ভিটামিন, অ্যান্টিঅক্সিডেন্টস, পটাশিয়াম, ফসফরাস, ম্যাগনেশিয়াম ইত্যাদি। হার্ট ও মস্তিষ্কের জন্যও মধু খুবি উপকারী।
পলি-আনস্যাটুরেটেড ফ্যাট: পলি-আনস্যাচুরেটেড ফ্যাট (যেমনঃ ডকোসাহেক্সায়নিক আসিড (ডি এইচ এ) শিশুর বুদ্ধিবৃত্তিক ক্রিয়া, অপরের সাথে সম্পর্ক গঠন, দৈনন্দিন কাজ করা ইত্যাদি ক্ষমতার উন্নতি করে। সামুদ্রিক মাছের তেল, বাদাম, বীজজাতীয় খাবার থেকে এই ধরণের ফ্যাট পাওয়া যায়।
একটি শিশু তার যে খাবার খেতে ভালো লাগে, শুধু সেটিই খেতে চায়। বিভিন্ন রকমের খাবার খাওয়ানো এ সময় বেশ কঠিন একটি চ্যালেঞ্জ। কিন্তু বাড়ন্ত বয়সের চাহিদা মেটাতে কষ্টসাধ্য হলেও নানা রকমের খাবার শিশুকে খাওয়াতে হবে। তার ভালো লাগার খাবারের পাশাপাশি অন্যান্য গুরুত্বপূর্ণ পুষ্টিসমৃদ্ধ খাবার খাওয়ার অভ্যাস করাতে হবে। এভাবেই শিশুর মস্তিষ্কের বিকাশে প্রয়োজনীয় পুষ্টির অভাব মেটানো সম্ভব।