কথায় আছে, Morning shows the day- অর্থাৎ সূচনার উপরেই নির্ভর করে ভবিষ্যত কেমন হবে। যেকোন মানুষের ছেলেবেলাই তার জীবনের সূচনালগ্ন বলা যায়। এ সময়ে গড়ে উঠা অভ্যাস পরবর্তী জীবনে সহজে বদলায় না। খাদ্যাভ্যাসের বিষয়ে কথাটি আরো বেশি সত্য। একটি শিশু ছোটবেলা থেকে খাবারের যে অভ্যাসে অভ্যস্ত হয়, পরবর্তীতে সহজে সেটি থেকে বের হতে পারে না। দেখা গেছে, ছোটবেলায় যেসব খাবারে অনীহা সৃষ্টি হয়, বড় হওয়ার পর সে খাবার খাওয়ার অভ্যাস আর হয় না। একইভাবে ছোটবেলায় যে খাবারটি ভালো লেগে যায়, তা বড় হওয়ার পরেও সহজে বদলায় না।
সুস্থ থাকার জন্য দরকার সঠিক খাদ্যাভ্যাস। দেহের জন্য প্রয়োজনীয় পুষ্টি পেতে হলে নিয়মিত খেতে হবে পুষ্টিকর খাবার। কিন্তু খাবারের ব্যাপারে উদাসীনতা বা অনিয়মের প্রভাব শরীরে সরাসরিভাবেই প্রকাশ পায়। তাই সুস্থ খাদ্যাভ্যাস প্রতিটি মানুষের জন্য জরুরি। ছোটবেলা থেকে যদি খাবারের অভ্যাস সঠিক শৃঙ্খলায় গড়ে না উঠে, বড় হওয়ার পর বহু কষ্টে তা গড়তে হয়। শুধু বড় হওয়ার পর যে এর প্রভাব পড়ে তা নয়- সঠিক খাদ্যাভ্যাসের অনুপস্থিতিতে শিশুকে ভুগতে হয় স্থুলতা, অপুষ্টি, ডায়াবেটিস ইত্যাদির মতো জটিল সমস্যায়। সেগুলো পরবর্তীতে আর ভয়াবহ আকার ধারণ করতে পারে। তাই খুব ছোট বয়স থেকেই শিশুকে ভালো ও পুষ্টিকর খাবারে অভ্যস্ত করতে হবে।
খাবারের অভ্যাস গড়তে হলে প্রথমে নজর দিতে হবে শিশুর মানসিক অবস্থার উপর। প্রতিটি শিশুরই আলাদা পছন্দ-অপছন্দ আছে। এসব পছন্দ-অপছন্দের ব্যাপারের কিছুটা আসে মাতৃগর্ভে থাকা অবস্থায় পাওয়া খাবার থেকে, কিছু আসে চারপাশের মানুষদের দেখে। তাই আগে থেকেই সচেতন হলে শিশুকে নিয়মিত ও সুষম খাবারে অভ্যস্ত করা সম্ভব।
এক টেবিলে খেতে বসুন একসাথে: পরিবারের সবাই মিলে একসাথে খেতে বসা শিশুর সঠিক খাদ্যাভ্যাস গড়ার জন্য হতে পারে বেশ কার্যকর। এক টেবিলে বসে খাওয়ার মুহূর্তটি টিভির সামনে কিংবা একা বসে নিঃশব্দে খাওয়ার চেয়ে অনেক বেশি আনন্দময়। এ সময় পরিবারের বড়দের খাওয়ার অভ্যাস দেখে ছোটরাও সে খাবারের অভ্যাস গড়ে তুলতে শুরু করে। আর টিভি কিংবা অন্য কোন বিনোদনের মাধ্যম সামনে রেখে খেলে বেশি খাওয়ার অভ্যাস গড়ে উঠে। তাই প্রতি বেলায় সম্ভব না হলেও সপ্তাহে কয়েকবার অন্তত একসাথে খাওয়ার অভ্যাস করা উচিৎ।
বাইরের খাবারের বদলে ঘরের খাবার খাওয়া: বাইরে থেকে অর্ডার করে খাবার খাওয়ার প্রবণতা বেশি হলে শিশুরা ফাস্ট ফুড ও বিভিন্ন অস্বাস্থ্যকর জাঙ্ক ফুডে আসক্ত হয়ে পড়ে। খুব জরুরি না হলে সপ্তাহে একবারের বেশি বাইরের খাবার খাওয়া উচিৎ নয়। আর সকাল কিংবা বিকালের নাস্তাতেও ঘরে তৈরি করা খাবার কিংবা তাজা ফলমূল খাওয়ার অভ্যাস গড়ে তুলতে হবে। বাইরের বিস্কিট, কেক কিংবা অন্যান্য ভাজাপোড়া খাবার এড়িয়ে চলার অভ্যাস ঘর থেকেই শুরু করতে হবে।
নিজেই হয়ে উঠুন রোল মডেল: বলা হয়ে থাকে, শিশুরা তার পরিবারের সদস্যদের কাছ থেকেই শিক্ষা পায়। শিশুকে ভালো খাবার খাওয়ার উপদেশ দিয়ে নিজে অস্বাস্থ্যকর খাদ্যাভ্যাস মেনে চললে শিশুও এমন অভ্যাসেই অভ্যস্ত হবে। তাই প্রতি বেলার প্রধান খাবারগুলোর পাশাপাশি নাস্তায় সঠিক খাবার খাওয়ার অভ্যাস করুন। এতে আপনি নিজেই হবেন শিশুর খাবারের অভ্যাসের জন্য ইতিবাচক রোল মডেল। এছাড়া খাওয়ার সময় একা না খেয়ে অন্যদেরকেও কিছু খাবে কি না তা জিজ্ঞেস করুন, যা দেখে শিশু সবার সাথে খাবার শেয়ার করার বিষয়টি শিখতে পারে।
খাবার যেন কোন পুরষ্কার বা শাস্তি না হয়: অনেকে শিশুকে কোন কিছু শেখানোর জন্য বা কোন কাজ করার বিনিময়ে খাবার খাওয়ানোর লোভ দেখান। কিংবা অনেক সময় কোন কাজ থেকে বিরত থাকার জন্য ভয় দেখাতে বিশেষ কোন খাবার খাওয়ানোর ভয় দেখান। এতে করে শিশুটি অতিরিক্ত শর্করা বা চিনিযুক্ত বিভিন্ন খাবারকে ধরেই নিবে ভালো খাবার, আর যা মুখোরোচক নয় তাকে খারাপ খাবার হিসেবে ধরে নিবে। এতে করে সুস্থ খাদ্যাভ্যাসে আসতে অনেক বেশি সমস্যার মুখোমুখি হতে হবে। তাছাড়া শাস্তি হিসেবে যদি কোন অস্বাস্থ্যকর খাবার খাওয়া থেকে শিশুকে দূরে রাখা হয়, তবে সে অজান্তে সেই ধরণের খাবারের প্রতিই বেশি আগ্রহী হবে।
ওজন নিয়ে মন্তব্য করা যাবে না: ‘মোটা হয়ে যাবে’, ‘পেট বড় হয়ে যাবে’, ‘মোটা হলে সবাই পঁচা বলবে’ এসব কথা দিয়ে অস্বাস্থ্যকর খাবার থেকে শিশুকে দূরে রাখার চেষ্টা করলে হিতে বিপরীত হতে পারে। বরং এতে করে খুব ছোট বয়স থেকেই সে নিজের ওজন নিয়ে দুশ্চিন্তা শুরু করবে, এবং কোন কারণে ওজন বেড়ে গেলে সে বিষণ্ণতায় ভুগতে শুরু করবে। এতে করে খাবারের প্রতি সৃষ্টি হবে অমূলক ভয়। তাই ভালো খাবারের অভ্যাস গড়তে গিয়ে ওজনের কথা একেবারেই বলা যাবে না।
রান্নার সময় তারাও অংশ নিক: গবেষণায় দেখা গেছে, যেসব শিশু রান্নার সময় নিজেরা অংশগ্রহন করে তারা বিভিন্ন রকমের খাবার খেতে উৎসাহী হয়, এবং খাবারের প্রতি তাদের অনীহা কম থাকে। ছোট ছোট কাজ যেমন চামচ বা বাসন এগিয়ে দেয়া, মসলা মেপে দেয়া ইত্যাদি কাজে তারা হাত দিলে সে খাবারের প্রতি তাদের আগ্রহ বেশি থাকে। নিজেদের রান্না খাওয়ার জন্য এই আগ্রহ তাদের খাবারে বাছবিচার করার প্রবণতা কমায়। তাছাড়া এতে করে নিজেরা স্বাবলম্বী হওয়ার শিক্ষাও পায়।
জোর করে কিছু চাপানো যাবে না: বিভিন্ন কারণে কোন কোন খাবারের প্রতি শিশুর অনীহা আসতেই পারে। কিন্তু তার জন্য সেই খাবার খাওয়াতেই বেশি জোর করা যাবে না। তাতে আরো বেশি বিতৃষ্ণা এবং একই ধরণের খাবার খেতেও সে অনীহা দেখাতে পারে। বরং নিয়মিত সেই খাবার ভিন্ন উপায়ে রান্না করে নিজেরা খেলে একসময় শিশুটি নিজেই তা খেতে কৌতুহল দেখাবে।
তাই শিশুর সুস্থ খাবারের অভ্যাস গড়তে উপদেশ বা আদেশ নয়, বরং তাদের জন্য ইতিবাচক উদাহরণ ও পরিবেশের সৃষ্টি করাই হলো পরিবারের বড়দের কাজ। এতে করেই সে পরবর্তীতে নিজের জন্য ভালো খাদ্যাভ্যাসে অভ্যস্ত হবে।