শিশুর রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা বাড়াতে হলে যা করতে হবে

শত রকমের সাবধানতা মেনে চললেও শিশুকে রোগবালাইয়ের হাত থেকে সবসময় দূরে রাখা সম্ভব হয় না। একজন প্রাপ্তবয়স্ক মানুষের চেয়ে একটি শিশুর রোগে আক্রান্ত হওয়ার প্রবণতা স্বাভাবিকভাবেই বেশি। কারণ জন্ম নেয়ার পর থেকে একটি শিশুর দেহের রোগ প্রতিরোধ ব্যবস্থা পরিবেশের বিভিন্ন জীবাণুর সাথে পরিচিত হতে শুরু করে। ধীরে ধীরে এটি এসব রোগের বিরুদ্ধে লড়াই করার ক্ষমতা অর্জন করে। তাই ছোটদের অনেক সময়ই রোগবালাই লেগেই থাকে।

তবে এসব রোগের বিরুদ্ধে লড়াইয়ের ক্ষমতা বাড়াতে হলে রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা বৃদ্ধির দিকে মনোযোগ দিতে হবে। রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা যত বেশি হবে, একটি শিশু তত সহজে সুস্থ হয়ে উঠতে পারবে। এবং কিছু কিছু ক্ষেত্রে রোগবাহী জীবাণু শুরুতেই ধ্বংস করে দেবে। আর দুর্বল রোগ প্রতিরোধ ব্যবস্থা শিশুর  রোগে ভোগার প্রবণতা তো বাড়াবেই, এর প্রভাব তাকে বয়ে নিয়ে চলতে হবে প্রাপ্তবয়স্ক অবস্থাতেও। বার বার রোগে ভোগার কারনে বা জীবানুর সাথে লড়াই করবার জন্যে শিশুর দেহের নিজের পুষ্টিও ব্যবহৃত হয় যা শিশুর শারীরিক ও মানসিক বৃদ্ধিতে বাধা দেয়, এবং শিশু অপুষ্টিতে ভোগে।
তাই শিশুকে জীবাণু থেকে দূরে রাখার সাথে সাথে আরেকটা জরুরি কাজ হলো তার রোগ প্রতিরোধ ব্যবস্থাকে আরো শক্তিশালী করা। আর তার জন্য অভিভাবকেরা কিছু সহজ নিয়ম মেনে চললেই সফল হতে পারেন।

সঠিক খাদ্যাভ্যাসের বিকল্প নেই: 
শিশুর জীবনে প্রথম খাদ্য হলো মাতৃদুগ্ধ। তাতে থাকে প্রচুর পরিমাণে রোগ প্রতিরোধী এন্টিবডি এবং শ্বেত রক্তকণিকা। নবজাতকের বিভিন্ন রোগ থেকে শুরু করে প্রাপ্ত বয়সের নানা রোগের বিরুদ্ধে এটি প্রতিরোধ গড়তে শুরু করে। তাই জন্মের পর প্রথম ৬ মাস (১৮০ দিন)  শিশুকে মায়েরর দুধ যথাযথ নিয়মে খাওয়াতে হবে। যেকোন ফর্মুলা বা বাজারজাত করা দুধের চেয়ে এটি অনেক গুণ বেশি কার্যকর।
শিশু বেড়ে উঠার সাথে সাথে ৭ মাসের শুরু থেকে সে ধীরে ধীরে বিভিন্ন রকমের খাবার গ্রহণ করতে শুরু করে, এবং বিভিন্ন পারিবারিক খাবারে অভ্যস্ত হতে শুরু করে। তাই শুরু থেকেই তাকে এমন খাবারের সাথে অভ্যস্ত করতে হবে, যা তার দেহের জন্য প্রয়োজনীয় পুষ্টির যোগান দেয় এবং তার রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতাকে শক্তিশালী করে তুলতে সহায়তা করে।

শিশুর রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা বৃদ্ধি করে এমন কিছু খাবার (৬ মাস বয়স শেষ হলে দেয়া যেতে পারে)-

দুধ: শুধু হাড় মজবুত করার জন্যেই নয়, ইমিউন সিস্টেম বা রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা বাড়াতেও দুধের ভূমিকা অনেক। এর ভিটামিন ডি দেহের রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতাকে বাড়িয়ে তোলে।

দই: দই প্রোবায়োটিক সমৃদ্ধ একটি খাবার। অর্থাৎ এতে থাকে শরীরের জন্য উপকারী ব্যাকটেরিয়া। দইয়ে ভিটামিন ডি ও আছে অনেক। দই পেটের বিভিন্ন রোগের বিরুদ্ধে কার্যকর তো বটেই, সর্দি-কাশির বিরুদ্ধেও এটি বেশ উপকারী।

ভিটামিন-সি সমৃদ্ধ ফল ও সবজি: ভিটামিন সি শরীরের রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা বাড়ানোর পাশাপাশি যেকোন কাটাছেঁড়া দ্রুত সারাতে ভূমিকা রাখে। পাশাপাশি কোষের ক্ষয়রোধ করতেও এটি ভূমিকা রাখে। কমলা, মাল্টা, বরই, লেবু, আলু, ক্যাপসিকাম ইত্যাদি ভিটামিন সি-তে ভরপুর খাবার খেতে শিশুদের উৎসাহিত করুন।
ভিটামিন-এ সমৃদ্ধ খাবার: ভিটামিন এ শরীরের ইনফেকশন সারাতে ভূমিকা রাখে। পাশাপাশি রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা বাড়াতেও এটি ভূমিকা রাখে। গাজর, মিষ্টি আলু, পালং শাক, ডিম, মাংস ইত্যাদি ভিটামিন এ সমৃদ্ধ খাবার খেতে শিশুদের উৎসাহিত করুন।

ভিটামিন-ই সমৃদ্ধ খাবার: ভিটামিন ই ব্যাকটেরিয়া ও ভাইরাসের সাথে যুদ্ধ করতে সাহায্য করে। পাশাপাশি কোষের ক্ষয়রোধ করতেও এটি ভূমিকা রাখে। পালং শাক, ব্রকলি, বাদাম ইত্যাদি ভিটামিন ই সমৃদ্ধ খাবার খেতে শিশুদের উৎসাহিত করুন।

মাংস: মাংসে থাকা জিংক রক্তের শ্বেত রক্তকণিকাদের আরো বেশি শক্তিশালী করে তোলে। আর এই শ্বেতরক্তকণিকা দেহের ক্ষতিকর জীবাণু ধ্বংস করে। তবে অতিরিক্ত চর্বিযুক্ত মাংস থেকে শিশুদের দূরে রাখাই ভালো।

ওমেগা-৩ সমৃদ্ধ খাবার: বিভিন্ন সামুদ্রিক মাছের তেল ও বাদামে এই উপাদানটি প্রচুর পরিমাণে পাওয়া যায়। এটিও শ্বেতকণিকার কার্যক্ষমতা বাড়াতে সাহায্য করে, ফলে দেহে ইনফেকশনের হার কমে। এই উপাদানটি শিশুর বুদ্ধি বৃদ্ধিতেও সাহায্য করে। ইলিশ মাছে অনেক ওমেগা-৩ থাকে। ছোট শিশুরা মাছ কম খেলে তিসি বা তিলের তেল দিয়ে রান্না করা খাবার দেয়া যেতে পারে। এই উদ্ভিদজাত তেলেও অনেক ওমেগা-৩ উপাদান থাকে।

মাশরুম: মাশরুমে থাকে ভিটামিন ডি ও বিভিন্ন এন্টি অক্সিডেন্ট উপাদান, যা রোগ প্রতিরোধ বাড়াতে ভূমিকা রাখে। পাশাপাশি এতে থাকে প্রচুর পরিমাণে প্রোটিন, খেতেও বেশ সুস্বাদু। নাস্তা কিংবা মূল খাবারের সাথে শিশুরা বেশ আগ্রহ নিয়েই এটি খেয়ে থাকে।

খাবারের ব্যাপারে আরো যেসব দিকে খেয়াল রাখতে হবে তা হলো-
১- শিশুর জন্য সব ধরনের খাবারের সুষম সমন্বয় রাখতে হবে।
২- যতোই উপকারী হোক, কোন খাবারই অতিরিক্ত খাওয়াবেন না।
৩- শুধু খাবারের উপরেই রোগ বা সুস্থ থাকা নির্ভর করে না। অন্যান্য কারণেও রোগ হতে পারে।
৪- যতটা সম্ভব তাজা খাবার খাওয়ার অভ্যাস করতে হবে।

চাই নিয়মিত ঘুম
গবেষণায় দেখা গেছে, পর্যাপ্ত ঘুমের অভাবে দেহের সুরক্ষাকারী কোষ বা কোষের নির্যাস, যেগুলো বিভিন্ন জীবাণু ও রোগ ধ্বংস করে, সেগুলোর পরিমাণ কমে যায়। ফলে দেহ তার স্বাভাবিক রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা কিছুটা হারায়। তাই শিশুদের যেন পর্যাপ্ত ঘুম হয়, সেদিকে লক্ষ্য রাখা দরকার। যত ছোট শিশুর বয়স তার ঘুমের প্রয়োজনও তত বেশি। ৩-৫ বছর বয়সী শিশুর ১০-১৩ ঘণ্টা, ৬-১৩ বছর বয়সী শিশুর ৯-১১ ঘণ্টা ও ১৪-১৭ বছর বয়সী কিশোর কিশোরীদের ৮-১০ ঘণ্টা ঘুমের প্রয়োজন। এতে করে তাদের দেহ স্বাভাবিক নিয়মেই অনেক রোগ থেকে নিজেদের প্রতিরোধ করতে পারবে।

খেলাধুলা বা ব্যায়াম 
নিয়মিত খেলাধুলা বা শারীরিক কসরত বা পরিমিত ব্যায়াম শিশুর রোগ প্ররোধ ক্ষমতা বাড়ায়, শারীরিক বৃদ্ধিতে সাহায্য করে, শিশুকে হাসিখুশি রাখে এবং তার পড়াশুনায় মনোযোগ বাড়াতে সাহায্য করে।

টিকা নিয়ে হেলাফেলা চলবে না 
নির্দিষ্ট বয়সে কিছু টিকা শিশুর জন্য অপরিহার্য। ঠিক সময়ে ডাক্তারের পরামর্শ অনুযায়ী শিশুকে টিকা দিতে হবে। আর বিদেশে ভ্রমণের আগে জেনে নিতে হবে কোন বিশেষ টিকা নিতে হবে কি না।

পরিচ্ছন্নতা
পরিচ্ছন্নতার সাধারণ নিয়মগুলো মেনে চললে বেশিরভাগ রোগ থেকেই বেঁচে থাকা যায়। শিশুদের ক্ষেত্রে পরিচ্ছন্নতা আরো বেশি জরুরি। তাদের সঠিক নিয়মে পরিষ্কার পরিচ্ছন্ন থাকার শিক্ষা দিতে হবে, এবং ইতিবাচক উদাহরণ দিয়ে তাদের উৎসাহ বাড়াতে হবে। নিয়মিত হাত ধোয়া, যেখানে সেখানে হাত না দেয়া, হাঁচি কাশির সময় মুখ ঢেকে রাখা ইত্যাদি নিয়ম মানলে দেহের রোগ প্রতিরোধের উপর অতিরিক্ত চাপ পড়ে না। ফলে স্বাভাবিক নিয়মে সেটি দেহকে নীরোগ রাখার জন্য কাজ করে যেতে পারে।
সচেতনতা ও কিছু খুব সাধারণ নিয়ম মানলেই ছোটদেরকে বিভিন্ন রোগের প্রভাব থেকে অনেকটা দূরে রাখা যায়। তাই নিয়মিত কিছু সতর্কতা মানা ও নিয়মমাফিক জীবনযাপনে অভ্যস্ত করলেই শিশুর বাল্যকাল কাটবে রোগে ভোগার যন্ত্রণা ছাড়াই।

facebook.com linkedin.com twitter.com
Categories:

Leave a Reply

শিশুর মস্তিষ্কের বিকাশে প্রয়োজন যে ৮টি খাবার
প্রতিটি পরিবারে বাচ্চাদের খাবার নিয়ে থাকে বাড়তি সচেতনতা। বাচ্চাদের সুস্বাস্থ্যের কথা বিবেচনা করে, বাচ্চার বয়স
শিশুর আয়োডিনের ঘাটতি হলে কোন ৫টি সমস্যা দেখা দেয়?
শিশুর আয়োডিনের ঘাটতি হলে যে ৫টি সমস্যা দেখা দেয় বিভিন্ন গবেষণায় দেখা যায়, আয়োডিনের ঘাটতির
পরীক্ষার সময় মনোযোগ ধরে রাখতে ও সুস্থ থাকতে প্রয়োজন পুষ্টিকর খাবার
স্টুডেন্ট লাইফ মানেই প্রতিদিন নতুন কিছু শেখা। শিক্ষা জীবনে স্টুডেন্টদের পরীক্ষার মাধ্যমেই ধাপে ধাপে এগিয়ে
দৈহিক সুস্থতায় প্রতিদিনের খাদ্যতালিকায় জিংক কেন প্রয়োজন?
সুস্থ থাকতে হলে আমাদের প্রতিদিনের খাদ্যতালিকা বিভিন্ন পুষ্টিকর উপাদানে পরিপূর্ণ থাকা চাই। সহজভাবে বলতে চাইলে,
don't worry about summer
প্রচন্ড গরমে নিমিষেই দূর হবে সারাদিনের ক্লান্তি
রোদের তাপ ক্রমশ বাড়ছে তাই না? এদিকে এই গরমের দিনে মিসেস শারমিনকে থাকতে হয় সারাদিন
গরমে সুস্থ থাকতে কেমন খাবার খাওয়া চাই?
ইদানীং অনেক গরম পড়েছে তাই না? চারিদিকে গরমের দাবদাহে জীবন প্রায় অতিষ্ঠ। কিন্তু জীবন-জীবীকার খোঁজে আমাদের
কম খরচে পুষ্টি চাহিদা পূরণ করতে খাদ্যতালিকা যেমন হওয়া উচিত
বাজার করতে গিয়ে হিমশিম খাচ্ছেন? মাছ-মাংসের দাম শুনলেই মনে হয় বাজারে আগুন লেগে আছে। কিন্তু
DHA এবং ব্রেইন ডেভেলপমেন্ট
ডোকোসাহেক্সনিক এসিড বা সংক্ষেপে DHA হলো মস্তিষ্ক গঠনের একদম প্রাথমিক উপাদান। সহজ করে বললে DHA
গর্ভাবস্থায় প্রোটিন কেন জরুরি ?
গর্ভকালীন সময়ে গর্ভস্থ সন্তানের পরিপূর্ণ বিকাশ নিশ্চিতে মায়ের চাই বাড়তি যত্ন ও সব রকমের পুষ্টি
বুদ্ধিতে বৃদ্ধিতে সন্তানের চাই সঠিক পুষ্টি
পুষ্টি ও ভারসাম্যপূর্ণ খাদ্যাভ্যাস বাড়ন্ত শিশুর জন্য খুব জরুরি। কেননা জন্মের পর প্রথ এই কয়েক