‘বিশ্বে যা কিছু মহান সৃষ্টি চির কল্যাণকর
অর্ধেক তার করিয়াছে নারী, অর্ধেক তার নর।’
আজকের এই পৃথিবী নারী ও পুরুষ-উভয়ের অবদানেই গড়া। দুই লিঙ্গের সদস্যদেরই অক্লান্ত পরিশ্রম ও ত্যাগেই আমরা সুন্দর ভবিষ্যতের স্বপ্ন দেখি। অধিকার ও সম্মানে নারী ও পুরুষ সমান হবে, এমনই এক পৃথিবী আমরা চাই। তবে শারীরিক গঠনের ক্ষেত্রে দুই লিঙ্গের স্বাভাবিকভাবেই কিছুটা ভিন্নতা রয়েছে। নারীদের দেহের জন্যে যেমন কিছু বিশেষ পুষ্টি চাহিদা আছে, তেমনই পুরুষদেরও কিছু বিষয়ে আলাদাভাবে যত্নশীল হওয়া প্রয়োজন। পুরুষের স্বাস্থ্যের জন্য কিছু বিশেষ পুষ্টিগুণ নিয়ে সচেতন থাকা দরকার।
পুরুষের বিশেষ পুষ্টি চাহিদা
পুরুষের দেহের গঠন নারী দেহের চেয়ে ভিন্ন। প্রকৃতির নিয়মেই সাধারণত তাদের দেহের গড়ন কিছুটা বড় হয়ে থাকে। এছাড়া তাদের হরমোনের ভারসাম্যও অনেক দিক থেকে সম্পূর্ণভাবে ভিন্ন। একজন পুরুষের দেহে ক্যালোরির প্রয়োজন হয় বেশি। এছাড়া পুরুষের টেস্টোস্টেরনের কারণে পেশির ভরও ভিন্ন হয়ে থাকে। তাই প্রোটিন তাদের দেহের জন্য অনেক বেশি গুরুত্বপূর্ণ। অন্যান্য পুষ্টি উপাদান যেমন জিংক, ক্যালসিয়াম, পটাশিয়াম, ভিটামিন ই এবং সি এর অভাব পুরুষের শরীরে বেশ ক্ষতিকর প্রভাব ফেলে।
যেসব সমস্যায় পুরুষেরা বেশি ভোগেন
পুরুষের শারীরিক সমস্যার মধ্যে প্রধান হলো হৃদরোগ। পৃথিবীজুড়ে পুরুষদের মৃত্যুর প্রধান কারণ হলো হার্ট অ্যাটাক। এছাড়া যকৃত ও কিডনির সমস্যা, প্রস্টেট ক্যান্সার, ডায়াবেটিস, ইরেকটাইল ডিসফাংশন ইত্যাদি রোগ পুরুষের স্বাস্থ্যের জন্য হুমকি হিসেবে দেখা দেয়। বয়স বৃদ্ধির সাথে সাথে হরমোনের পরিবর্তনে এরকম বিভিন্ন সমস্যা শুরু হতে থাকে।
খাদ্য তালিকায় যেমন পরিবর্তন চাই
কম ক্যালরী যুক্ত খাবার গ্রহণ: মহিলার চেয়ে একজন পুরুষের ক্যালরীর চাহিদা স্বাভাবিক ভাবেই বেশি। কিন্তু আধুনিক বিশ্বে অফিস কাজের চাপ বেশি এবং হাঁটা-চলা বা ওয়ার্ক আউটের সুযোগ কম থাকায় বর্তমানে পুরুষের ক্যালরীর চাহিদা পূর্বের থেকে কম বলে ডায়েটেশিয়ানরা মনে করছেন। এছাড়া বয়স বাড়ার সাথে সাথে শরীরের মেটাবলিক রেট কমে যাওয়ায় অধিক ক্যালরী যুক্ত খাবার যেমনঃ অতিরিক্ত তেলযুক্ত খাবার, তেলে ভাজা খাবার, বিরিয়ানি, তেহারি, পেস্ট্রি ইত্যাদি খাবার কম গ্রহণ করা বা বাদ দেয়া প্রয়োজন। অতিরিক্ত কার্বোহাইড্রেট যেমনঃ চিনিযুক্ত খাবার, অতিরিক্ত ভাত, প্রসেস কার্বোহাইড্রেট (বার্গার, পিজা, পাউরুটি) এড়িয়ে চলতে হবে।
প্রথম শ্রেণীর প্রোটিন গ্রহণ করা: পুরুষ ও মহিলা উভয়েরই উন্নত মানের প্রোটিনের প্রয়োজন হলেও তুলনমূলক ভাবে পুরুষের প্রোটিন বেশি মাত্রায় প্রয়োজন হয়। কারণ পুরুষের শরীরে লিন মাসলের পরিমাণ বেশি। অপরদিকে বয়স বাড়ার সাথে সাথে রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা বৃদ্ধি ও পেশীর ক্ষয় রোধ করতে প্রোটিনের প্রয়োজন হয়। সাধারনত ৩২ বছরের একজন পুরুষ যার ওজন ৮০ কেজি যদি লিন মাসল বৃদ্ধি করতে চায়, তাহলে তার ডেইলি ৭০-৮০ গ্রাম প্রোটিন গ্রহণ করা উচিত। আর রাতে কার্বোহাইড্রেটের তুলনায় প্রোটিন বেশি খেতে বলা হয় কারণ, প্রোটিন সারারাত তার শরীরের লিন মাসল তৈরিতে সাহায্য করে।
ভিটামিন ও মিনারেলস: বয়স বাড়ার সাথে সাথে শরীরের মেটাবলিক রেট কমে যাবার জন্য ক্যালরীর চাহিদা কমে যায়। কিন্তু তখন ভিটামিন ও মিনারেলসের চাহিদা বৃদ্ধি পায়। তখন ডায়েটে বেশি পুষ্টি সমৃদ্ধ খাবারের প্রয়োজন হয়। মানসম্মত পুষ্টির প্রয়োজন হয় পুরুষের রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা বাড়াতে। পাশাপাশি হাড় ক্ষয় রোধ, দৃষ্টি শক্তি কমে যাওয়া, পেশি ক্ষয় ইত্যাদি বয়সজনিত সমস্যাকে প্রতিহত করতে অ্যান্টিঅক্সিডেন্ট (Antioxident) যেমনঃ ভিটামিন এ, ডি, ই, কে বেশি দরকার হয়।
ক্যালসিয়াম ও ভিটামিন ডি: বর্তমান বিশ্বে সামাজিক নানা ব্যস্ততার কারণে পুরুষদের এমনিতেই শরীরে প্রাকৃতিক রোদ লাগানো হয় না। কর্মব্যস্ত জীবন এবং এয়ারকন্ডিশনযুক্ত অফিসে বেশি সময় কাজ করায় ৪০ বছরের বেশি বয়সী পুরুষদের ক্যালসিয়াম ও ভিটামিন ডি এর অভাব পরিলক্ষিত হচ্ছে যা পরবর্তীতে অষ্টিওপোরেসিসে রুপ নিতে পারে। আর এজন্য প্রতিদিন অন্তত ৩০ মিনিট সকালের রোদে থাকা ও খাদ্য তালিকায় ভিটামিন ডি ও ক্যালসিয়াম সমৃদ্ধ খাবার যেমনঃ দুধ, দই, ছানা, সামুদ্রিক মাছ, কাঠ বাদাম ইত্যাদি কিছু পরিমানে থাকা উচিত।
চর্বি হতে পারে মৃত্যুর কারণ: যদিও পরিমিত মাত্রায় চর্বি খাবারের সাথে থাকা প্রয়োজনীয়, অতিরিক্ত ও খারাপ ধরণের চর্বি (ট্রান্স ফ্যাট) স্বাস্থের জন্য মারাত্বক ক্ষতিকর। অতিরিক্ত চর্বিযুক্ত খাবার কোলেস্টেরল বৃদ্ধি করে, যা হার্ট অ্যাটাক ও স্ট্রোকের জন্য প্রত্যক্ষভাবে দায়ী। তাই ভাজাপোড়া খাওয়া একদম পরিমিত পর্যায়ে রাখতে হবে, লাল মাংস ও অন্যান্য প্রাণিজ চর্বি থেকে দুরত্ব বজায় রাখতে হবে।
মাছের তেল: সব ধরণের তেলজাতীয় খাবার খারাপ তো নয়ই, বরং কিছু কিছু স্নেহজাতীয় খাবার দেহের জন্য অনেক বেশি উপকারি। মাছের তেলে থাকে এমন সব উপাদান, যা হৃদযন্ত্রের সুস্থতা রক্ষার পেছনে কাজ করে। এছাড়া এটি মস্তিষ্কের জন্যও উপকারী।
খেতে হবে আঁশযুক্ত খাবার: পুরুষের খাদ্যতালিকায় সাধারণত ২০ গ্রামের কাছাকাছি ফাইবার থাকে। কিন্তু সুস্বাস্থ্য বজায় রাখতে হলে এর পরিমাণ হওয়া উচিৎ অন্তত ৩০ গ্রাম। হৃদরোগ, টাইপ ২ ডায়াবেটিস ও অতিরিক্ত ওজনের ক্ষতিকর প্রভাব থেকে এই উপাদানটি দেহকে রক্ষা করে। সাদা চাল কিংবা ময়দার পরিবর্তে লাল চালের ভাত কিংবা লাল আটার রুটিতে থাকে প্রচুর ফাইবার। এছাড়া ছোলা, ডাল, বাদাম ইত্যাদিতেও থাকে ফাইবারের প্রাচুর্য।
নিয়মিত খাবারে থাকুক শাকসবজি: পরিসংখ্যানে দেখা গেছে, প্রতি ৫ জন পুরুষের মধ্যে একজন মাত্র পুরুষ তার দৈনন্দিন চাহিদা অনুযায়ী শাকসবজি খেয়ে থাকেন। এর ফলে তারা বিভিন্ন স্বাস্থ্যঝুঁকিতে থাকেন। প্রতিবেলার খাবারে শুধু শর্করা বা মাছ-মাংসে প্রাধান্য না দিয়ে পরিমিত পরিমাণে শাকসবজি রাখতে হবে।
লবণ কমলে ঝুঁকিও কমবে: উচ্চ রক্তচাপের সমস্যায় নারীদের চেয়ে পুরুষেরাই বেশি ভুগেন। আর এর ফলে তাদের হৃদরোগের ঝুঁকিও থাকে বেশি। উচ্চ রক্তচাপের অন্যতম একটি কারণ হলো অতিরিক্ত লবণ খাওয়া। তাই খাবারের সাথে অতিরিক্ত লবণ নেয়ার অভ্যাস বন্ধ করতে হবে, পাশাপাশি বিভিন্ন ফাস্ট ফুড ও লবণ ভরা স্ন্যাক্স খাওয়াও কমাতে হবে। খাবারের স্বাদ বাড়াতে লেবু বা ধনেপাতার মতো স্বাস্থ্যকর উপায় বেছে নিতে হবে।
প্রস্টেট যেন ভালো থাকে: জিংক, ভিটামিন সি, ওমেগা-৩ ফ্যাট ও লুটেইনের মতো এন্টি অক্সিডেন্ট প্রস্টেট ভালো রাখে। টমেটো, বিভিন্ন সবুজ শাকসবজি, বাদাম ও বীজজাতীয় খাবার খেলে প্রস্টেট ক্যান্সারের ঝুঁকি অনেকাংশে কমে যায়।
বদলাতে হবে দৈনন্দিন রুটিনও
খাদ্যাভ্যাসের পরিবর্তন দেহের জন্য যেমন দরকার, তেমনি দরকার জীবনযাত্রায় পরিবর্তন আনা। নিয়মিত শরীরচর্চা নারী পুরুষ উভয়ের জন্যেই দরকার। তবে পুরুষের হৃদরোগের প্রবণতা কমাতে শরীরচর্চা হতে পারে একটি অন্যতম উপায়। এছাড়া ধূমপান কিংবা অন্য কোন মাদক সেবনে পুরুষই সংখ্যায় এগিয়ে। সুস্থভাবে বাঁচার জন্য এ ধরণের অভ্যাসের ইতি টানা জরুরি।