গর্ভকালীন সময়টি নারীর জীবনে অনেক গুরুত্বপূর্ণ একটি সময়। এ সময়ে একজন নারী নিজ দেহে আরেকটি প্রাণকে ধারণ করে, তাকে পৃথিবীর আলোতে নিয়ে আসার জন্য প্রস্তুত করে। আর তাই এ সময়টিতে সবচেয়ে বেশি খেয়াল রাখতে হয় যে বিষয়গুলোতে, তার মধ্যে অন্যতম হলো পুষ্টি। অনাগত শিশুর এবং ভবিষ্যৎ প্রসূতি মায়ের সুস্থতা অনেকটাই নির্ভর করে এটির উপরে। সন্তানসম্ভবা মায়েদের সে কারণে খাদ্যের ব্যাপারে অনেক বেশি সচেতন ও সতর্ক থাকতে হয়।
গর্ভাবস্থায় মায়ের দেহে যা প্রয়োজন
‘গর্ভাবস্থায় দু’জনের কথা ভেবে খেতে হয়’- কথাটি আক্ষরিক ভেবে নিয়ে শুধু পরিমাণে বেশি করে খাওয়া মোটেই ঠিক নয়। বরং গর্ভের ভ্রূণের সুস্থ বৃদ্ধির এবং মায়ের পরবর্তী সুস্বাস্থ্যের কথা ভেবে খাদ্যতালিকা সাজাতে হবে। বিশেষজ্ঞদের মতে, গর্ভবতী মায়েদের
গর্ভাবস্থায় প্রথম ৩ মাসে প্রতিদিন ৮৫ কিলোক্যালরি
দ্বিতীয় ৩ মাসে ২৫০ কিলোক্যালরি এবং
শেষ তিন মাসে ৫০০ কিলোক্যালরি প্রতিবেলার খাবারে অতিরিক্ত গ্রহন করা উচিত।
এবং এই খাবার হতে হবে সুষম ও নির্দিষ্ট কিছু পুষ্টি উপাদানে সমৃদ্ধ। গর্ভবতী নারীদের প্রতিবেলার খাবারে অন্তত ১২০০ মিলিগ্রাম ক্যালসিয়াম, ৬০০-৮০০ মাইক্রোগ্রাম ফলেট ও ২৭ মিলিগ্রাম আয়রন থাকা আবশ্যক। তাই সাধারণত যেসব খাবার খেয়ে থাকেন, সে খাবারের অভ্যাসে একটু পরিবর্তন আনতেই হবে।
খাবারে যেসব উপাদান চাই-ই চাই
প্রোটিন: আমাদের দেহ গঠিত হয় প্রোটিন দিয়ে। গর্ভে থাকা ভ্রুণও প্রোটিন শোষণ করে ধীরে ধীরে পূর্ণতা পায়। তাই গর্ভবতী মায়েদের খাবারে প্রোটিন থাকা অনেক বেশি জরুরি। বিশেষ করে প্রসূতি কালীন সময়ে মাতৃদুগ্ধ তৈরীর অন্যতম উপাদান প্রোটিন। গর্ভবতী নারীদের খাবারে স্বাভাবিক পরিমানের চেয়ে অন্তত ২০ গ্রাম বেশি প্রোটিন রাখতে হয়। আর এই প্রোটিন শুধু এক রকমের আমিষজাতীয় খাবার থেকেই আসলে হবে না। ভিন্ন ভিন্ন আমিষের উৎসে থাকে ভিন্ন রকমের এমাইনো এসিড। মাংস, মাছ, দুগ্ধজাত খাবার, বিভিন্ন রকমের বাদাম ও ডাল থেকে প্রয়োজনীয় প্রোটিন পাওয়া যেতে পারে।
ক্যালসিয়াম: দেহের ভেতর বড় হয়ে ওঠা ভ্রূণটির হাড় ও দাঁত গঠনের জন্য দরকার হয় প্রচুর পরিমাণে ক্যালসিয়াম। খাবারের সাথে পর্যাপ্ত পরিমাণে ক্যালসিয়াম না পেলে মায়ের দেহ থেকেই ভ্রুণটি ক্যালসিয়াম শুষে নেয়। তাই এইসময়ে ঝুঁকি এড়াতে খাবারের সাথে প্রতিবেলা কমপক্ষে ১০০০-১৩০০ মিলিগ্রাম ক্যালসিয়াম গ্রহন করতে হয়। এছাড়া স্নায়ু, হৃদপিন্ড ও পেশির জন্যেও ক্যালসিয়াম দরকার হয়। এ কারণে এ সময় বেশি করে দুধ, দই, পনিরের মতো দুগ্ধজাত খাবার, কাঁটাসহ ছোটমাছ, পোস্তদানা ও বিভিন্ন রকমের সবুজ শাকসবজি যেমন লালশাক, পুঁইশাক, কলমি শাক, ব্রকলি, বাঁধাকপি, ফুলকপি ইত্যাদি খেতে হবে। মনে রাখতে হবে প্রতিবেলা খাবারের সাথে ভিটামিন সি যুক্ত খাবার ক্যালসিয়াম এবং আয়রন শোষণে সহায়তা করে। শেষের ছয় মাস অন্তত দিনে ২-৩ গ্লাস দুধ অথবা দুধ জাতীয় খাবার গ্রহণ করা জরুরী।
ফ্যাট: ‘ফ্যাট’ শব্দটি অস্বাস্থ্যকর খাবারের অপর নাম বলে অনেকে মনে করলেও আসলে তা মোটেও ঠিক নয়। ফ্যাট বা চর্বি দেহের সুস্থ্যতার জন্য অপরিহার্য। গর্ভবতী নারীদের খাবারে স্নেহজাতীয় পদার্থ থাকা আরো বেশি জরুরি, কারণ ভ্রুণের মস্তিষ্ক ও চোখের গঠনের জন্য এটি অনেক গুরুত্বপূর্ণ। রোগ প্রতিরোধ ব্যবস্থা গঠনেই রয়েছে এর ভূমিকা। এছাড়া শিশুর জন্মের পর তার শক্তির উৎসই হলো এই জমানো ফ্যাট। তাই ফ্যাট এড়িয়ে নয়, খাবার তালিকা বানাতে হবে সঠিক পরিমাণে স্নেহযুক্ত খাবার দিয়ে।
উদ্ভিজ্জ তেল ও সামুদ্রিক তৈলাক্ত মাছ তো আছেই, পাশাপাশি ডাল, কলিজা, শিম, মাখন ইত্যাদি খেতে হবে নিয়মিত। তবে ফ্যাটের রকমভেদে সতর্ক হতে হবে। মনোআনস্যাচুরেটেড ও পলিআনস্যাচুরেটেড ফ্যাটে ক্ষতি নেই, তবে স্যাচুরেটেড ফ্যাট (প্রাণীজ ফ্যাট) খেতে হবে পরিমিত। আর বিভিন্ন ফাস্ট ফুড, মার্জারিন, কেকের আইসিং ইত্যাদিতে থাকা ট্রান্স ফ্যাট এড়িয়ে যেতে হবে।
ফলিক এসিড: ভ্রুণের ডিএনএ, মস্তিষ্ক, রক্তকণিকা ইত্যাদি গঠনে এই ফলিক এসিডের ভূমিকা বেশ গুরুত্বপূর্ণ। এছাড়া কাঁটা ঠোঁট, হৃদযন্ত্রে সমস্যাসহ নানা ধরণের জন্মগত ত্রুটি রোধ করার ক্ষমতা রাখে এই উপাদানটি। তাই খাবার থেকে যেন এই ফলিক এসিড বাদ না পড়ে, সেদিকে অবশ্যই খেয়াল রাখতে হবে। ডাল, পালংশাক, বাদাম, টমেটো এটির প্রধান উৎস। তবে গর্ভকালীন সময়ে ফলিক এসিডের পরিমিত যোগান দিতে ক্যাপসুল সেবনের প্রয়োজনও হয়ে থাকে।
আয়রন: ভ্রুণের শরীরে পর্যাপ্ত অক্সিজেন সরবরাহ ও হিমোগ্লোবিন তৈরি করতে প্রয়োজন হয় আয়রনের। কলিজা, মাংস, ডাল, সিম, বাদাম, ডিম ইত্যাদি প্রাকৃতিক উৎস থেকে প্রচুর আয়রন পাওয়া যায়। তবে ঘাটতি মেটাতে আয়রন ট্যাবলেট খাওয়ার প্রয়োজনও পড়তে পারে।
ভিটামিন সি: ভিটামিন সি কোলাজেন গঠনে ভূমিকা রাখে, যা শিশুর টিস্যু গঠনের জন্য প্রয়োজনীয়। এছাড়া খাদ্যের সাথে গ্রহণ করা আয়রন শোষণের জন্যও দরকার ভিটামিন সি। টকজাতীয় ফল, টাটকা শাকসবজি, অঙ্কুরিত ছোলা, কাঁচামরিচ থেকেই গর্ভবতী মায়েরা এই ভিটামিন পেতে পারেন।
ভিটামিন এ: ত্বক ও চোখের গঠনের জন্য অত্যাবশ্যক হলো ভিটামিন এ। এছাড়া রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতার জন্যও এটি দরকারী। তাই ছোট মাছ, রঙিন শাকসবজি ও ফলমূল খাদ্যতালিকায় অবশ্যই রাখতে হবে।
গর্ভাবস্থায় ওজন বৃদ্ধি খুবই স্বাভাবিক
গর্ভধারণের সময় মায়ের ওজন যদি না বাড়ে, সন্তানের ওজনও পর্যাপ্ত পরিমাণে বাড়তে পারে না। ফলে নবজাতকের জন্মের পর দেখা যেতে পারে নানা রকমের সমস্যা। বিশেষজ্ঞদের মতে, গর্ভাবস্থায় একজন নারীর ওজন তৃতীয় সপ্তাহের পর থেকে প্রতি সপ্তাহে আধা কেজি করে বৃদ্ধি পাওয়া উচিৎ। তবে প্রথম দিকে ওজন এই হারে বৃদ্ধি না পেলেও পরবর্তীতে ওজন স্বাভাবিকভাবেই বাড়ে। প্রথম তিন মাস যাওয়ার পর ওজন স্বাভাবিক হারে না বাড়লে বরং খাবারের উপর আরো বেশি মনোযোগী হতে হবে। স্বাভাবিক ওজনের একজন নারীর ওজন গর্ভকালীন সময়ে ১১-১৬ কেজি বৃদ্ধি পাওয়া উচিৎ। তবে আন্ডারওয়েট হলে সেই বৃদ্ধি ১২-১৮ কেজি হওয়া স্বাভাবিক। আর গর্ভবতী হওয়ার আগে থেকেই ওভারওয়েট নারীদের জন্য ওজন বৃদ্ধির পরিমাণ ৭-১১ কেজির মধ্যে থাকা স্বাভাবিক। তবে দেহের ধরণ, ডায়াবেটিস ও অন্যান্য কারণে এই সংখ্যার তারতম্য হতে পারে। তাই এ সময় সুস্থতার জন্যই দরকার হয় ওজনের।
এছাড়াও আয়োডাইজড সল্ট এবং দৈনিক তিন থেকে সাড়ে তিন লিটার বিশুদ্ধ পানি অত্যন্ত জরুরী। যে কোন কৃত্রিম রঙযুক্ত খাবার, ফ্লেবার, টেস্টিং সল্ট, অথবা প্রিজারভেটিভযুক্ত খাবার খাওয়া থেকে বিরত থাকতে হবে।
অতরিক্ত চা-কফি পরিহার করাই ভালো। বমি বমি ভাব থাকলে তরল খাবার থেকে শুকনো জাতীয় খাবার খেলে ভালো কাগবে।
গর্ভকালীন সময়টির গুরুত্ব যেমন বেশি, এ সময় সতর্ক থাকার প্রয়োজনও বেশি। তাই প্রয়োজনীয় পুষ্টিগুণে ভরপুর খাবার খাওয়ার পাশাপাশি অভ্যাস করতে হবে সুস্থ জীবনযাপনের।