গর্ভাবস্থা এমন একটি সময় যখন গর্ভে সন্তানের জীবনের ভীত তৈরি হয় এবং একজন গর্ভবতী নারীর পুষ্টি চাহিদা পূরণের উপরই তা সম্পূর্ণভাবে নির্ভর করে। এ সময় গর্ভবতী মা যত প্রয়োজনীয় পুষ্টি উপাদানসহ সুষম খাবার খাবেন, গর্ভের সন্তান ততোই সুস্থভাবে বেড়ে উঠবে এবং জন্মের পরেও তার সুস্থতা নিশ্চিত করা ততোই সহজ হবে। গর্ভধারণের সম্পূর্ণ সময়টাকে তিন মাস করে তিনটি পর্ব বা Trimester-এ ভাগ করা হয়।
প্রথম তিন মাস
মাঝের তিন মাস
শেষের তিন মাস
প্রতি তিন মাসিক পর্বই একজন গর্ভবতীর জন্য অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। তবে পুষ্টিগত চাহিদা প্রতি তিন মাসে পরিবর্তনশীল যা নির্ভর করে গর্ভবতীর বয়স, উচ্চতা, গর্ভধারণপূর্ব ওজন/BMI, গর্ভাবস্থায় ওজন, গর্ভকালীন সময় (কত সপ্তাহ), ভ্রূণের সংখ্যা (একক/যমজ) সহ অন্য কোনো রোগ থাকলে তার অবস্থা, রিপোর্ট ইত্যাদির উপর। তারমধ্যে প্রথম তিনমাসের পুষ্টি চাহিদা সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ; কারণ, গর্ভাবস্থার প্রথম মাসে গর্ভধারণ এবং ইমপ্ল্যান্টেশন সহ অনেকগুলো বিষয়ই ঘটে থাকে। অর্থাৎ, শিশুর চোখের বর্ণ, চুলের রঙ এবং লিঙ্গের মতো বড় বিষয়গুলো নির্ধারিত হয়ে থাকে এ সময়ে। ফলে, মাইক্রোনিউট্রিয়েন্ট – বিশেষ করে ফোলেট, আয়রন ইত্যাদির চাহিদা বেশি থাকে।
খাদ্যতালিকায় রাখতে হবে:
প্রথম মাসের পর গর্ভের শিশুটির দৈর্ঘ্য সামান্য বাড়ে এবং বিকাশের প্রথম পর্যায় শুরু হয়। তাই এ সময়ে প্রধানত পুষ্টি উপাদানসহ যে খাবারগুলো খেতে হবে সেগুলো হচ্ছে –
১) দুধ ও দুধজাতীয় খাবার:
ক্যালসিয়াম, ভিটামিন ডি, প্রোটিন, স্বাস্থ্যকর ফ্যাট এবং ফোলিক অ্যাসিড সহ শক্তির একটি দুর্দান্ত উৎস দুধ। তাই প্রথম তিন মাসের গর্ভাবস্থায় খাবারের মধ্যে দই, দুধ, ছানা ইত্যাদি রাখতে হবে।
২) ফোলেট সমৃদ্ধ খাবার:
গাঢ় সবুজ রঙের শাক-সবজি, যেমন – পালং শাক, বাঁধাকপি, লেবু জাতীয় ফল, বিচিজাতীয় সবজি, মটরশুঁটি, মসুর ডাল, ছোট বাঁধাকপি, ঢেঁড়স ইত্যাদি।
এসব খাবার শিশুর স্নায়ুর যথাযথ বিকাশের জন্য অপরিহার্য, যা পরবর্তীতে শিশুর মস্তিষ্ক এবং মেরুদণ্ডের কোষে বিকশিত হয়।
৩) শর্করা বা কার্বোহাইড্রেট:
ভিটামিন বি-কমপ্লেক্স, আয়রন, ম্যাগনেসিয়াম, সেলেনিয়ামের মতো খনিজের স্বাস্থ্যকর উৎস হচ্ছে কমপ্লেক্স কার্বোহাইড্রেট ফাইবার, যা এ সময় মায়ের শক্তির চাহিদা পূরণ করতে এবং গর্ভস্থ শিশুর বৃদ্ধির জন্য অপরিহার্য। চাল, গম (আটা), বার্লি, সাগু, ওটমিল ইত্যাদি এসব খাদ্যগুণের উৎস।
৪) আমিষ বা প্রোটিন:
ডিম এবং মাংস হলো প্রোটিন, ভিটামিন এ, বি২, বি৫, বি৬, বি১২, ডি, ই, কে এবং ফসফরাস, সেলেনিয়াম, ক্যালসিয়াম ও জিঙ্কের মতো খনিজগুলির চমৎকার উৎস; যা গর্ভাবস্থার প্রথম তিন মাসে ভ্রূণের সুস্থ বিকাশকে নিশ্চিত করবে।
৫) ফল:
ডালিম, কলা, পেয়ারা, কমলালেবু, লেবু, স্ট্রবেরি এবং আপেলের মতো ফলগুলিতে শিশুর বিকাশের জন্য প্রয়োজনীয় বিভিন্ন ভিটামিন, খনিজ এবং অ্যান্টিঅক্সিডেন্ট থাকে।
৬) সব ধরনের সবজি:
মা ও শিশুর জন্য ভিটামিন এবং মিনারেলের গুরুত্বপূর্ণ উৎস হতে পারে সবজি। যেমন- ব্রোকোলি, বাঁধাকপি, পালং শাক, গাজর, কুমড়ো, মিষ্টি আলু, টমেটো, ক্যাপসিকাম, ভুট্টা, সজনের ডাঁটা, বেগুন ইত্যাদি।
৭) বিভিন্ন বীজ ও বাদাম জাতীয় খাবার:
বিভিন্ন বীজ এবং বাদাম হলো স্বাস্থ্যকর ফ্যাট (ওমেগা-৩), ভিটামিন, প্রোটিন, খনিজ, ফ্ল্যাভোনিয়েডস এবং স্বাস্থ্যকর ফাইবারের চমৎকার উৎস, যা শিশুর সুস্থতার জন্য গর্ভাবস্থায় প্রথম তিন মাসে নিয়মিত খেতে হবে।
৮) মাছ:
মাছ কম ফ্যাটযুক্ত এবং ওমেগা-৩ ফ্যাটি অ্যাসিড, উচ্চ মানের প্রোটিন, ভিটামিন বি২, ডি ও ই এবং পটাসিয়াম, ক্যালসিয়াম, জিঙ্ক, আয়োডিন, ম্যাগনেসিয়াম এবং ফসফরাসের মতো খনিজের একটি খুব ভালো উৎস, যা গর্ভবতী মায়েদের ও গর্ভস্থ শিশুর জন্য অপরিহার্য।
৯) আয়রন:
গর্ভবতী মায়েদের জন্য আয়রনসমৃদ্ধ খাবার অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ; কারণ, মায়ের হিমোগ্লোবিন তৈরি করতে এবং ভ্রূণে অক্সিজেন ও পুষ্টি সরবরাহ করতে আয়রন অত্যন্ত জরুরি একটি পুষ্টি উপাদান। আায়রনসমৃদ্ধ খাবারগুলি হলো – কলিজা, সয়াবিন, বিচিজাতীয় খাবার/বিনস, মসুর ডাল, রাজমা, খেজুর, জাম্বুরা, আনার, কিসমিস, কচু, কচুশাক সহ অন্যান্য শাক ইত্যাদি।
এছাড়াও গর্ভবতী নারীর পুষ্টি চাহিদা পূরণে অন্যান্য সব ধরনের খাবার পরিমাণমত খেতে হবে।
খাদ্যতালিকা থেকে বাদ দিতে হবে:
তবে কিছু খাবার গর্ভাবস্থায় ঝুঁকির কারণ হতে পারে, সেগুলি গর্ভবতী মায়েদের খাদ্যতালিকা বাদ দিতে হবে। যেমন:
১) কৃত্রিম সুইটনার / Alternative Sugar:
অ্যাস্পার্টাম, সুক্রালোজ এবং স্যাকারিন-এর মতো কৃত্রিম সুইটনারগুলি গর্ভবতী মায়েদের ফিনাইলকেটোনুরিয়া (পিকিইউ) তৈরি করে এনজাইম প্রক্রিয়াকরণে শরীরের ক্ষমতাকে প্রভাবিত করতে পারে। ফলে গর্ভস্থ সন্তানের জন্মগত ত্রুটি হতে পারে।
২) নরম চিজ বা পনির:
নরম পনিরে ব্যাকটেরিয়া থাকতে পারে, যা খাদ্য বিষক্রিয়ার কারণ হতে পারে, তাই গর্ভাবস্থার সময় নরম পনির এড়িয়ে চলাই উচিত ।
৩) প্যাকেট-জাত ও প্রক্রিয়াজাত খাবার:
প্যাকেটজাত খাবার যেমন – জুস, মাইক্রোওয়েভে প্রস্তুত খাবার, কেক, বিস্কুট, কনডেন্সড মিল্ক ইত্যাদি প্রিজারভেটিভ দেওয়া ও উচ্চ মাত্রার চিনি ও সোডিয়াম যুক্ত খাবার খাদ্য বিষক্রিয়ার কারণ হতে পারে; যা গর্ভের শিশুর স্বাস্থ্য ঝুঁকির কারণ হতে পারে।
৪) সামুদ্রিক খাবার:
সিফুড বা সামুদ্রিক খাবারে পারদের উচ্চ স্তর থাকে, যা ভ্রূণের মস্তিষ্কের ক্ষতি এবং বিকাশ ব্যাহত করে এবং গভীর পানির সামুদ্রিক মাছে মারকিউরি থাকায় অকাল গর্ভপাত হওয়ার ঝুঁকি তৈরি হতে পারে। তাই গর্ভধারণের প্রথম তিন মাস সিফুড এড়িয়ে চলাই ভালো।
৫) পেঁপে:
কাঁচা এবং আধা-পাকা পেঁপেতে ল্যাটেক্স থাকে, যা গর্ভাশয়ের সংকোচন শুরু করে এবং অকাল প্রসব এমনকি গর্ভপাতের কারণ হতে পারে। গর্ভাবস্থার প্রথম তিন মাস এগুলি এড়িয়ে চলা ভালো ।
৬) আনারস:
আনারসে ব্রোমেলাইন নামে একটি পদার্থ থাকে, যা সার্ভিক্সকে নরম করে তুলতে পারে ফলে প্রাথমিক গর্ভাবস্থায় গর্ভপাত বা অকাল প্রসব হতে পারে।
৭) কাঁচা বা আধ-সিদ্ধ মাংস:
কাঁচা বা আধ-সিদ্ধ মাংসে ব্যাকটেরিয়া, সালমোনেলা, লিস্টারিয়া ইত্যাদি থাকতে পারে, যা গুরুতর সংক্রামক রোগের ঝুঁকি তৈরি করে গর্ভজাত শিশুর বিকাশকে ব্যাহত করতে পারে এবং মা ও শিশুর স্বাস্থ্যের গুরুতর ক্ষতি করতে পারে ।
৮) জাঙ্ক ফুড:
গর্ভাবস্থায় বেশি পরিমাণে জাঙ্ক ফুড খেলে ডিপ্রেশন, উদ্বেগ, মনোযোগ-ঘাটতি, হাইপারঅ্যাক্টিভিটি ডিজঅর্ডারের মতো মানসিক স্বাস্থ্য সমস্যাগুলির ঝুঁকি তৈরি হতে পারে।
এছাড়া তামাকজাতীয় খাবার, অ্যালকোহল, অতিরিক্ত কফি অকাল গর্ভপাতের ঝুঁকি তৈরি করতে পারে বলে এসব খাবার বাদ দেওয়া ভালো।
গর্ভস্থ ভ্রূণের সার্বিক সুস্থতা নিশ্চিত করতে গর্ভাবস্থায়, বিশেষ করে প্রথম তিন মাস স্বাস্থ্যকর খাবার (পুষ্টিবিদের পরামর্শ অনুযায়ী) স্বাস্থ্যকর জীবনযাপন, পর্যাপ্ত পরিমাণে পানি পান, প্রয়োজনমতো ঘুম এবং শারীরিক পরিশ্রম (চিকিৎসকের পরামর্শ মত) করা অত্যন্ত জরুরি।