করোনাভাইরাস ও কোভিড-১৯: যা জানতে হবে, যা করতে হবে

এই ক’দিনে বিশ্বব্যাপী প্রতিটি মানুষের মুখে সবচেয়ে বেশি উচ্চারিত হওয়া দুটি শব্দ সম্ভবত ‘করোনা’ ও ‘কোভিড -১৯’। পৃথিবীর সবচেয়ে বড় সমস্যার কথা জিজ্ঞেস করলে কয়েক মাস আগেও হয়তো শোনা যেত যুদ্ধ-বিগ্রহ, দূষণ বা অর্থনৈতিক অস্থিতিশীলতার কথা। কিন্তু এই নতুন দশকের শুরুতেই সবার আতঙ্কের কারণ হয়ে দাঁড়িয়েছে এই ভাইরাসটি। এই আতঙ্ক মোটেও অমূলক কিছু নয়। ভয়াবহ মাত্রায় সংক্রামক এই ভাইরাস কমবেশি সারা বিশ্বেই ছড়িয়ে পড়েছে, হচ্ছে বহু মৃত্যুর কারণ।

নোভেল করোনাভাইরাস ও কোভিড-১৯
করোনাভাইরাস বলতে শুধু একটি ভাইরাসকেই বোঝায় না, বরং এটি ভাইরাসের একটি পরিবার। এগুলোকে আবার ভাগ করা যায় চারটি প্রজাতিতে। এদের মধ্যে কিছু প্রজাতি সাধারণ ঠান্ডা-ফ্লু, কিছু আবার শ্বাসযন্ত্রের রোগের জন্য দায়ী। এগুলোর কোনটি আবার প্রাণীদেহ থেকে মানুষের শরীরে এসে নতুন রূপ নিতে পারে, পরিবর্তন হতে পারে এদের কার্যক্ষমতার। বর্তমানের মহামারীর পেছনে সব করোনাভাইরাস দায়ী নয়, দায়ী হচ্ছে নভেল করোনাভাইরাস (SARS-CoV-2)।

এই নতুন ধরণের করোনাভাইরাসটির সূচনা হয় ২০১৯ সালে চীনের উহান প্রদেশে। এর আগে মানবদেহে এর উপস্থিতি কখনো ছিলো না। ধারণা করা হয়, উহানের একটি সামুদ্রিক মাছের বাজারে যাওয়া মানুষের মাঝে এক ধরণের ভাইরাল নিউমোনিয়ার সংক্রমণ দেখা দেয়। সেখান থেকেই গণহারে এর সংক্রমণ শুরু হয় বলে ধারণা করা হয়। তবে আরেকটি রিপোর্ট থেকে জানা যায়, এই ভাইরাসে আক্রান্ত হওয়ার প্রথম ঘটনা ঘটে ২০১৯ সালের ১ ডিসেম্বর, যার সাথে ওই মাছের বাজারের কোন সম্পর্কই ছিলো না। কীভাবে এর সূচনা ঘটে, তা নিয়ে এখনো তদন্ত চলছে।

শুরুতে এই নতুন করোনাভাইরাসের সংক্রমণের ফলে সৃষ্ট রোগের কোন নাম দেয়া হয় নি। পরবর্তীতে ওয়ার্ল্ড হেলথ অর্গানাইজেশন (WHO) ফেব্রুয়ারিতে এই রোগের নাম ‘কোভিড-১৯’ বলে ঘোষণা করে।কোভিড

যা জানতে হবে
সংক্রমণের স্থান: এই ভাইরাসে সংক্রমণ ঘটে প্রথমে গলায় ও ন্যাসফারনিক্সে এবং সেখান থেকে ফুসফুসে।

ছড়ানোর মাধ্যম: প্রধাণত এক ব্যাক্তির শরীর থেকে অন্য ব্যাক্তির শরীরে ছড়ায়। আক্রান্ত ব্যাক্তির ছয় ফুট দূরত্বের মধ্যে থাকলে এবং তাদের হাঁচি-কাশির সাথে বের হওয়া তরলের মাধ্যমে এই রোগ ছড়ায়। এছাড়া কোন বস্তুতে ভাইরাস লেগে থাকলে এবং তা হাত দিয়ে স্পর্শ করার পর নাক, মুখ বা চোখে হাত লাগলে সেখান থেকেও এই ভাইরাসের সংক্রমণ হতে পারে।

লক্ষণ: কোভিড-১৯ এর লক্ষণ জনভেদে ভিন্ন রূপে দেখা দিতে পারে। অনেকের হয়তো সামান্য অসুস্থতা দেখা দিবে, অনেকের ক্ষেত্রে তা নিউমোনিয়ার মতো রূপও নিতে পারে। কেউ হয়তো স্বাভাবিক চিকিৎসাতেই সেরে উঠবে, কোভিড-১৯ হওয়ার ব্যাপারটি টেরও পাবে না। তবে মূলত যেসব লক্ষণ দেখা যায় সেগুলো হলো-
⦁ জ্বর (১০০ ডিগ্রি ফারেনহাইটের উপরে)
⦁ শুকনো কাশি
⦁ গলাব্যাথা
⦁ শ্বাসকষ্ট
⦁ মাংসপেশিতে ব্যথা
⦁ প্রচন্ড দুর্বলতা
⦁ গন্ধ না পাওয়া এবং মুখের রুচি না থাকা

যারা গত ১৪ দিনের মধ্যে বিদেশ থেকে দেশে ফিরেছেন বা এমন কোন মানুষের সংস্পর্শে এসেছেন, তাদের মাঝে এসব লক্ষণ দেখা দিলে কোভিড-১৯ এর পরীক্ষা করানো জরুরি।

যারা সবচেয়ে বেশি ঝুঁকিতে আছেন:
⦁ যাদের বয়স ৭০ বা তার চেয়ে বেশি
⦁ অ্যাজমা, ব্রংকাইটিস ইত্যাদি শ্বাসতন্ত্রের রোগে ভোগা মানুষ
⦁ কিডনি ও লিভার রোগী
⦁ ডায়াবেটিস রোগী
⦁ হৃদরোগ আক্রান্ত ব্যাক্তি
⦁ রোগপ্রতিরোধ ক্ষমতা দুর্বল এমন ব্যাক্তি
⦁ গর্ভবতী নারী
⦁ ক্যান্সার রোগী যারা কেমোথেরাপি নিচ্ছে

আমাদের যা করনীয়

পরিচ্ছন্নতা বজায় রাখা: এই নভেল করোনাভাইরাস খুব দ্রুত সংক্রমিত হতে পারে, কিন্তু এটি ছড়িয়ে পড়ার জন্য মানুষের উপর নির্ভরশীল। মূলত হাঁচি কাশি ও হাতের স্পর্শ থেকেই এই ভাইরাসটি ছড়ায়। আর তাই সাধারণ পরিচ্ছন্নতার নিয়ম মেনেই এই জীবাণুর বিরুদ্ধে অনেকটা প্রতিরোধ গড়া যায়।
মুখ ঢেকে হাঁচি ও কাশি দিলে এই জীবানুবাহী তরল বায়ুতে মিশতে পারে না। ফলে সংক্রমণের ঝুঁকি অনেকটা কমে আসে। এবং হাঁচি কাশির সময় ব্যবহার করা টিস্যু যেখানে সেখানে না ফেলে নির্দিষ্ট স্থানে ফেলুন। যত্রতত্র থুথু ফেলা তো একদমই নিষিদ্ধ!
এছাড়া WHO এর নির্দেশমতে প্রতি ঘন্টায় একবার করে ৩০ সেকেন্ড ধরে হাত ধোয়া জরুরি। তা হতে পারে অ্যালকোহলযুক্ত স্যানিটাইজার দিয়ে, কিংবা ক্ষারযুক্ত সাবান দিয়ে। এতে করে হাতে থাকা জীবাণু ধ্বংস হওয়া অনেকটাই নিশ্চিত হয়।

নাক-মুখ-চোখে ধরবেন না: শুধু মানুষের সরাসরি সংস্পর্শেই নয়, যেকোন বস্তুর গায়েও লেগে থাকতে পারে এই ভাইরাস। আর সেটি স্পর্শ করার পর নাক-চোখ-মুখে হাত গেলে আপনার শরীরেও প্রবেশ করতে পারে এটি। সহজ কথায়, হাত অপরিষ্কার অবস্থায় কোন ভাবেই MEN এ ধরা যাবে না। এই MEN হলো mouth (মুখ), eyes (চোখ) ও nose (নাক)।

মাস্ক: হ্যাঁ, মাস্ক পরা জরুরি, যদি আপনার মাঝে কোভিড-১৯ এর কোন লক্ষণ প্রকাশ পায়। মাস্ক আমাদের মুখে স্পর্শ করার অভ্যাস কমায় এবং অন্যান্য দূষণ থেকে বাঁচায়।

অন্যের সংস্পর্শে আসা থেকে যথাসম্ভব বিরত থাকুন: এর সংক্রমণ মূলত মানুষের মাধ্যমেই। এই রোগটির লক্ষণ অনেক সময়েই শুরুতে বোঝা যায় না। সেই অবস্থায় অজান্তেই তা সংক্রমিত হতে পারে অন্যের দেহে। তাই অপ্রয়োজনে বাইরে বের হওয়া বা অতিরিক্ত ভীড়ে যাওয়া থেকে সাবধান থাকতে হবে। অপরের কাছ থেকে অন্তত তিন ফুট দূরত্ব বজায় রাখুন।

রান্নায় সতর্কতা বজায় রাখুন: মাছ মাংস রান্নার সময় ভালো করে ধুয়ে পরিষ্কার হাতে রান্না করুন, এবং তা যেন যথেষ্ট তাপে রান্না হয় সেদিকে খেয়াল রাখুন।

লক্ষণ দেখা দিলে: যদি কোভিড-১৯ এর কোন লক্ষণ আপনার মধ্যে দেখা যায়, তাহলে সাধারণ কোন হাসপাতাল বা চেম্বারে সরাসরি যাবেন না। আইইসিডিআরের হটলাইন বা কোভিড-১৯ এর চিকিৎসা সুবিধা সম্পন্ন নিকটস্থ সরকারি হাসপাতালে যোগাযোগ করতে হবে। এবং তা করতে হবে যথাসম্ভব দ্রুততার সাথে ও অপরের সংস্পর্শ এড়িয়ে।

কোয়ারেন্টাইন ও আইসোলেশন: যাদের মধ্যে এখনো কোভিড-১৯ এর লক্ষণ দেখা যায় নি, কিন্তু কোন কারণে তারা করোনাভাইরাসে সংক্রমিত হওয়ার ঝুঁকিতে ছিলেন, তাদের কোয়ারেন্টাইনে রাখা হয়। কোভিড-১৯ এর জন্য কোয়ারেন্টাইনের সময় ১৪ দিন। এর মধ্যে কোন উপসর্গ ধরা পড়লে তাকে আইসোলেশনে নিতে হবে। যার দেহে এই জীবাণুর উপস্থিতি ধরা পড়বে, বা কোন উপসর্গ দেখা দিবে, তাকে আইসোলেশনে রাখতে হবে। আইসোলেশন হলো সম্পূর্ণভাবে অন্যের সংস্পর্শ থেকে দূরে রেখে চিকিৎসা করা। আর তা করতে হবে হাসপাতালেই।

স্বাস্থ্যকর জীবনযাপন ও খারাপ অভ্যাস দূরে রাখা: বাসায় যথাসম্ভব সময় কাটানো পাশাপাশি স্বাস্থ্যকর খাদ্যাভ্যাসে মনোযোগী হতে হবে। এছাড়া নিয়মিত শরীরচর্চা করাও বেশ জরুরি। কারণ এই রোগ দেহের অন্যান্য রোগের ক্ষতিকর দিকটিকে বেশি মারাত্বক করে ফেলে। আর ধূমপান কিংবা অন্য কোন মাদক সেবনের অভ্যাস সম্পূর্ণ বাদ দিতে হবে। খেতে হবে নিয়মিত পর্যাপ্ত পরিমাণে পানি। ডায়বেটিক রোগীদের ব্লাড সুগার নিয়ন্ত্রণে রাখতে হবে। বেদনানাশক বা ব্যাথা কমানোর ঔষধ যেমন ডাইক্লোফেনাক ডাক্তারের পরামর্শ ছাড়া খাওয়া উচিত না।

এখনো এই কোভিড-১৯ এর কোন ওষুধ বা ভ্যকসিন আবিষ্কার হয় নি। সারা বিশ্ব শুধু স্বাস্থ্যের দিক দিয়েই নয়; সামাজিক ও অর্থনৈতিক বিভিন্ন দুর্যোগের মুখোমুখি হওয়ার প্রবল ঝুঁকিতে আছে। তাই আতঙ্কে নয়, সচেতনতা দিয়েই এই দুর্যোগে টিকে থাকতে হবে। তার জন্য সবাইকে একসাথে এবং নিজ নিজ স্থান থেকে কাজ করে যেতে হবে।

facebook.com linkedin.com twitter.com
Categories:

Leave a Reply

শিশুর মস্তিষ্কের বিকাশে প্রয়োজন যে ৮টি খাবার
প্রতিটি পরিবারে বাচ্চাদের খাবার নিয়ে থাকে বাড়তি সচেতনতা। বাচ্চাদের সুস্বাস্থ্যের কথা বিবেচনা করে, বাচ্চার বয়স
শিশুর আয়োডিনের ঘাটতি হলে কোন ৫টি সমস্যা দেখা দেয়?
শিশুর আয়োডিনের ঘাটতি হলে যে ৫টি সমস্যা দেখা দেয় বিভিন্ন গবেষণায় দেখা যায়, আয়োডিনের ঘাটতির
পরীক্ষার সময় মনোযোগ ধরে রাখতে ও সুস্থ থাকতে প্রয়োজন পুষ্টিকর খাবার
স্টুডেন্ট লাইফ মানেই প্রতিদিন নতুন কিছু শেখা। শিক্ষা জীবনে স্টুডেন্টদের পরীক্ষার মাধ্যমেই ধাপে ধাপে এগিয়ে
দৈহিক সুস্থতায় প্রতিদিনের খাদ্যতালিকায় জিংক কেন প্রয়োজন?
সুস্থ থাকতে হলে আমাদের প্রতিদিনের খাদ্যতালিকা বিভিন্ন পুষ্টিকর উপাদানে পরিপূর্ণ থাকা চাই। সহজভাবে বলতে চাইলে,
don't worry about summer
প্রচন্ড গরমে নিমিষেই দূর হবে সারাদিনের ক্লান্তি
রোদের তাপ ক্রমশ বাড়ছে তাই না? এদিকে এই গরমের দিনে মিসেস শারমিনকে থাকতে হয় সারাদিন
গরমে সুস্থ থাকতে কেমন খাবার খাওয়া চাই?
ইদানীং অনেক গরম পড়েছে তাই না? চারিদিকে গরমের দাবদাহে জীবন প্রায় অতিষ্ঠ। কিন্তু জীবন-জীবীকার খোঁজে আমাদের
কম খরচে পুষ্টি চাহিদা পূরণ করতে খাদ্যতালিকা যেমন হওয়া উচিত
বাজার করতে গিয়ে হিমশিম খাচ্ছেন? মাছ-মাংসের দাম শুনলেই মনে হয় বাজারে আগুন লেগে আছে। কিন্তু
DHA এবং ব্রেইন ডেভেলপমেন্ট
ডোকোসাহেক্সনিক এসিড বা সংক্ষেপে DHA হলো মস্তিষ্ক গঠনের একদম প্রাথমিক উপাদান। সহজ করে বললে DHA
গর্ভাবস্থায় প্রোটিন কেন জরুরি ?
গর্ভকালীন সময়ে গর্ভস্থ সন্তানের পরিপূর্ণ বিকাশ নিশ্চিতে মায়ের চাই বাড়তি যত্ন ও সব রকমের পুষ্টি
বুদ্ধিতে বৃদ্ধিতে সন্তানের চাই সঠিক পুষ্টি
পুষ্টি ও ভারসাম্যপূর্ণ খাদ্যাভ্যাস বাড়ন্ত শিশুর জন্য খুব জরুরি। কেননা জন্মের পর প্রথ এই কয়েক