ইনটুইটিভ ইটিং: যা খুশি খান, যতটুকু লাগে খান

খাবারের কথা বললেই তার সাথে ডায়েটের কথা চলেই আসে। খুব কম মানুষই আছেন, যারা নির্ভয়ে যা খুশি তা খেতে পারেন(ইটিং) । বেশিরভাগ মানুষেরই খাবার সময় ওজন বেড়ে যাওয়ার ভয় কাজ করে। অনেকের আবার চিন্তা হলো কী খেয়ে জিরজিরে শরীরে ওজন বাড়ানো যায়, তা নিয়ে। সমীক্ষা করলে দেখা যাবে, প্রতিটি মানুষই কোন না কোন ডায়েটে আছেন, কিংবা কোন ধরনের ডায়েট শুরু করেছিলেন। তা হতে পারে লো কার্ব, হতে পারে নো কার্ব, অথবা কিটো।

কিন্তু এরকম প্রথাগত ডায়েট মানেই শত রকমের নিয়ম, নিষেধ। কিছু মানুষ সফলভাবে ডায়েট টিকিয়ে রাখতে পারলেও বেশিরভাগ মানুষই শুরু করা ডায়েট থেকে ফসকে যান। অনেকে আবার ডায়েট ধরে না রাখতে পারার হতাশায় আরো বেশি অনিয়ন্ত্রিত খাদ্যাভ্যাসে অভ্যস্ত হয়ে পরেন।ইটিং

ইনটুইটিভ ইটিং হলো এসব প্রচলিত ডায়েটের সম্পূর্ণ বিপরীত। সাধারণ ডায়েটে কী খাওয়া যাবে, আর কী যাবে না; কতটুকু খেতে হবে বা কতটুকু পরিমানের বেশি খাওয়া যাবে না-তা নির্দিষ্ট করে বলা থাকে। আর ইনটুইটিভ ইটিং-এর মূলমন্ত্র হলো, ‘যা ইচ্ছা খাবেন, যতটুকু দরকার ততটুকু খাবেন, নিজের ইচ্ছায় খাবেন!’

অভিনব এই ‘খাদ্য-দর্শন’ ধীরে ধীরে পৃথিবীজুড়ে অনেকেই মেনে চলতে শুরু করছেন। এই খাদ্যাভ্যাসে খাবারের উপর সম্পূর্ণ নিয়ন্ত্রণ দেয়া হয় নিজের উপরেই। দেহও আপনার, ক্ষুধার অনুভূতিটাও আপনার। তাই কতটুকু খাবার শরীরে দরকার, তা নিজের ইনটুইশন বা অনুমান দিয়েই বুঝতে পারার কথা। এই নীতির উপর ভিত্তি করেই গড়ে উঠেছে ‘ইনটুইটিভ ইটিং’এর ধারণা। অন্যের কথা না শুনে নিজের দেহের জন্য কী ভালো হবে বা কী খারাপ হবে- তা নিজে নিজেই বের করতে হয় এই নিয়মে। এতে করে ডায়েট ভাঙ্গার অপরাধবোধ মনোবলকে ভাংতে পারে না, আর নিজের চাহিদা অনুযায়ী খেলে আত্মবিশ্বাসও থাকে বেশি। যা হতে পারে সুস্থ ও নীরোগ দেহ পাওয়ার একটি কার্যকর উপায়।

ইনটুইটিভ ইটিং-এর মূলকথা:

ডায়েটের মানসিকতা দূরে থাকবে:  ‘তিন মাসে ফিট হোন’, ‘সারাজীবনের জন্য চিকন হতে এই ডায়েট মেনে চলুন’, ‘দ্রুত ওজন কমান’-এ ধরণের ডায়েট করার মানসিকতা রাখতে হবে একদম দূরে। কোন ডায়েটের সব নিয়ম মানতে সবাই পারবে না-সেটাই স্বাভাবিক। কিন্তু ওজন কমাতে ব্যর্থ হয়ে নিজের উপরে সব দোষ চাপালে বরং আরো বেশি ক্ষতি হওয়ার সম্ভাবনা থাকে। হাল ছেড়ে দিয়ে দুঃখ ভুলতে অনেকেই অতিরিক্ত খাবার খাওয়া শুরু করেন। কিন্তু ইনটুইটিভ ইটিং এমন কোন কঠিন নিয়ম বেঁধে দেয় না। নিজের চাহিদা আর সদিচ্ছাকেই প্রাধান্য দেয় এই খাদ্যাভ্যাস।

ক্ষুধার মূল্যায়ন করুন: ক্ষুধা পেলে অবশ্যই খেতে হবে। না খেয়ে থাকলে ক্ষুধা অন্য সব অনুভূতিকে আচ্ছন্ন করে তোলে, ফলে না চাইলেও বেশি খাওয়া হয়ে যায়। তাই সময়মতো যে খাবারই পাওয়া যাক, তা খেয়ে নিতে হবে পরিমাণমতো।

কোন খাবার নিয়ে ভয় পাবেন না: কেক বা কাচ্চি-কোন বিশেষ খাবার হয়তো খুব খেতে ইচ্ছে করছে, কিন্তু মুটিয়ে যাওয়ার আতঙ্কে তা ছুঁয়েও দেখছেন না। এতে করে দেখা যাবে সেই খাবারটিই বেশি বেশি খাওয়ার ইচ্ছা হচ্ছে, এবং শেষপর্যন্ত নিয়ন্ত্রণ করতে না পেরে সেটি খেয়ে ফেলছেন অনেক বেশি। আর তা থেকে অনুতাপে ভোগা এবং হতাশ হয়ে পড়ার প্রবণতা শুরু হয়। ভবিষ্যতের অপেক্ষায় না থেকে বরং পছন্দের খাবার খেয়ে নিন।

খাবার নিয়ে দ্বিধা করবেন না: কোন খাবার ভালো না খারাপ, এমন দ্বিধা মনে রাখা যাবে না। এতে মনে নেতিবাচক চিন্তা বেড়ে যায়। খাবার নিয়ে মনের মধ্যে এমন দ্বিধা জাগলে সেটির বিরুদ্ধে প্রশ্ন করে দেখবেন, আসলে তা কতটা যুক্তিসঙ্গত।

ক্ষুধা মেটার পর খাবারের ইতি টানুন: আপনার শরীর যেমন কখন খেতে হবে বলে দেয়, কখন থামতে হবে তাও বলে দেয়। যেকোন খাবারই যথেষ্ট পরিমাণ খাওয়ার পর ক্ষুধা মেটার বিষয়টি শরীর জানিয়ে দেয়। কিন্তু খাবারের লোভ থেকেই হয় অতিরিক্ত খাওয়া। তাই কখন থামতে হবে- সে বিষয়টি অনুভব করতে হবে।

খাবার গ্রহণ করুণ তৃপ্তি নিয়ে: খাদ্যগ্রহণ উপভোগ করার মতো একটি ব্যাপার। যা খেতে ভালো লাগে, তা ধীরে সুস্থে উপভোগ করে গ্রহণ করুন। ঠিকভাবে উপভোগ করে খেলে খাবার খাওয়ার পরিমাণও হয় কম।

পেটের ক্ষুধায় খাবেন, মনের ক্ষুধায় নয়: অনেকে শুধু ক্ষুধা মেটাতেই খান না; দুঃখ, রাগ, হতাশা ভুলতেও খাবারকে ব্যবহার করেন। কিন্তু তা হলো খাবারের অপব্যবহার করা। হয়তো এমন সময় আসবে, যখন আপনার ক্ষুধা পাওয়ার কথা নয়, কিন্তু কিছু খেতে ইচ্ছে হচ্ছে। তখন নিজেকে প্রশ্ন করে জেনে নিবেন, এটি কি আসলেই ক্ষুধা, নাকি আবেগের প্রভাবে খাওয়ার ইচ্ছা। এমনটি হলে নিজের মনকে প্রশান্ত করার চেষ্টা করবেন, অন্য কোন গঠনমূলক কাজে মন দিয়ে এই অযাচিত খাওয়ার ইচ্ছাকে প্রশমিত করবেন।

দেহ নিয়ে হীনমন্যতায় ভুগবেন না: আপনার সৌন্দর্য আপনার দেহের আকারের উপর নির্ভর করে না। তাই খাবার নিয়ে অহেতুক ভয়ে না থেকে নিজের দেহকে মেনে নিবেন। খাবার বা ব্যায়াম করতে হবে দেহের আকার বদলানোর জন্য নয়, দেহকে সুস্থ রাখার জন্য।

কিভাবে এই ইটিং কাজ করেঃ ওহিও ইউনিভার্সিটির সাইকোলজি বিভাগের প্রফেসর ট্রেসী এল. টিলকা অনেক দিন থেকেই ইনটুইটিভ ইটিং নিয়ে কাজ করছেন। তার মতেঃ
১. এটি কোন মানুষকে চিন্তায় ফেলে না যে, এটা খাওয়া যাবে না বা ওটা খাওয়া যাবে না। ফলে ইনটুইটিভ ইটিং তার শরীর রিলাক্স থাকে ও বেশি খাওয়া থেকে বিরত রাখে।
২. এটি মানসিকভাবে আত্মবিশ্বাসী করে তোলে। ডায়েট না মেনে বেশি খেয়ে ফেলেছি কিনা-এ ধরণের হীনমন্যতায় কেউ ভুগে না এবং এটি অতিরিক্ত খাবার গ্রহণকে নিরুৎসাহিত করে।
৩. অন্য প্লান করে ডায়েট করলে ৫০ ভাগের বেশি রোগীর ওজন কমে যায়, কিন্তু পরবর্তীতে আবার ওজন বেড়ে যায়। ইনটুইটিভ ইটিং এর মাধ্যমে ওজন কমালে তা সহজে ধরে রাখা যায়।

১৫০০ নারী-পুরুষের উপরে গবেষণা করে দেখা গেছে যে, দৈনন্দিন খাওয়ার জন্য ওজন বাড়ে না, বরং ইমোশনাল ইটিং ও লাইফস্টাইল এর জন্য দায়ী। ইনটুইটিভ ইটিং অনুসরণ করলে কারো ওজন বাড়বে না, যদি কেউ নিম্নোক্ত দুটি বিষয় মেনে চলেনঃ

শরীরচর্চা: শরীরকে ভালো রাখতে হলে শরীরচর্চার বিকল্প নেই। কিন্তু শরীরচর্চা মানেই যে প্রায় সামরিক শৃঙ্খলায় নিজেকে বেঁধে কঠোরভাবে শরীর সঞ্চালন করতে হবে, তা নয়। সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ হলো শারীরিকভাবে সচল থাকা। যেভাবে নিয়মিত শরীরের সঞ্চালন করতে ভালো লাগে, সেভাবেই করবেন। হোক তা ভোর বা সন্ধ্যার মৃদু বাতাসে কিছুক্ষণ হাঁটা, অথবা একটু সাঁতার কাঁটা। নিয়মিত নিজের ভালো লাগা থেকে শরীরচর্চা করবেন, আর নিজের শরীরের ইতিবাচক পরিবর্তন নিজেই বুঝতে পারবেন।

পুষ্টি আর স্বাদকে গুরুত্ব দিন: মনে রাখবেন, খাবার যেন আপনার বিষণ্ণতার কারণ হয়ে দাঁড়াতে না পারে। প্রতিবেলার খাবার হয়তো একদম পুষ্টিগুণে আদর্শ হবে না। কিন্তু ধীরে ধীরে এই ইতিবাচক খাদ্যাভ্যাস আপনার শরীরেও ফেলবে ইতিবাচক প্রভাব।

এই খাদ্যাভ্যাস শুধু আপনি কী খাচ্ছেন তা নিয়ে কথা বলে না, কীভাবে খাচ্ছেন তা নিয়েও কথা বলে। সুস্থ থাকতে হলে একটি রুটিন অল্প দিনের জন্য মেনে চললে হবে না। তা পরিণত করতে হবে অভ্যাসে। আর নিজের পছন্দ-অপছন্দের সমন্বয়ে গড়া অভ্যাস মেনে চলা অন্য যেকোন ডায়েট মানার চেয়ে সহজ ও কার্যকর।

facebook.com linkedin.com twitter.com
Categories:

Leave a Reply

শিশুর মস্তিষ্কের বিকাশে প্রয়োজন যে ৮টি খাবার
প্রতিটি পরিবারে বাচ্চাদের খাবার নিয়ে থাকে বাড়তি সচেতনতা। বাচ্চাদের সুস্বাস্থ্যের কথা বিবেচনা করে, বাচ্চার বয়স
শিশুর আয়োডিনের ঘাটতি হলে কোন ৫টি সমস্যা দেখা দেয়?
শিশুর আয়োডিনের ঘাটতি হলে যে ৫টি সমস্যা দেখা দেয় বিভিন্ন গবেষণায় দেখা যায়, আয়োডিনের ঘাটতির
পরীক্ষার সময় মনোযোগ ধরে রাখতে ও সুস্থ থাকতে প্রয়োজন পুষ্টিকর খাবার
স্টুডেন্ট লাইফ মানেই প্রতিদিন নতুন কিছু শেখা। শিক্ষা জীবনে স্টুডেন্টদের পরীক্ষার মাধ্যমেই ধাপে ধাপে এগিয়ে
দৈহিক সুস্থতায় প্রতিদিনের খাদ্যতালিকায় জিংক কেন প্রয়োজন?
সুস্থ থাকতে হলে আমাদের প্রতিদিনের খাদ্যতালিকা বিভিন্ন পুষ্টিকর উপাদানে পরিপূর্ণ থাকা চাই। সহজভাবে বলতে চাইলে,
don't worry about summer
প্রচন্ড গরমে নিমিষেই দূর হবে সারাদিনের ক্লান্তি
রোদের তাপ ক্রমশ বাড়ছে তাই না? এদিকে এই গরমের দিনে মিসেস শারমিনকে থাকতে হয় সারাদিন
গরমে সুস্থ থাকতে কেমন খাবার খাওয়া চাই?
ইদানীং অনেক গরম পড়েছে তাই না? চারিদিকে গরমের দাবদাহে জীবন প্রায় অতিষ্ঠ। কিন্তু জীবন-জীবীকার খোঁজে আমাদের
কম খরচে পুষ্টি চাহিদা পূরণ করতে খাদ্যতালিকা যেমন হওয়া উচিত
বাজার করতে গিয়ে হিমশিম খাচ্ছেন? মাছ-মাংসের দাম শুনলেই মনে হয় বাজারে আগুন লেগে আছে। কিন্তু
DHA এবং ব্রেইন ডেভেলপমেন্ট
ডোকোসাহেক্সনিক এসিড বা সংক্ষেপে DHA হলো মস্তিষ্ক গঠনের একদম প্রাথমিক উপাদান। সহজ করে বললে DHA
গর্ভাবস্থায় প্রোটিন কেন জরুরি ?
গর্ভকালীন সময়ে গর্ভস্থ সন্তানের পরিপূর্ণ বিকাশ নিশ্চিতে মায়ের চাই বাড়তি যত্ন ও সব রকমের পুষ্টি
বুদ্ধিতে বৃদ্ধিতে সন্তানের চাই সঠিক পুষ্টি
পুষ্টি ও ভারসাম্যপূর্ণ খাদ্যাভ্যাস বাড়ন্ত শিশুর জন্য খুব জরুরি। কেননা জন্মের পর প্রথ এই কয়েক