জীবাণুই সবসময় দেহের সমস্যার জন্য দায়ী হয় না, অন্য অনেক কারণেও বিভিন্ন রোগ আক্রমণ করে আমাদের। তেমনই একটি রোগ হলো অস্টিওপোরোসিস। হাড়ের এই ভয়াবহ রোগটিতে পুরুষের চেয়ে নারীদের, বিশেষ করে মেনোপসের কয়েক বছর পর আক্রান্ত হওয়ার হার অনেক বেশি। এই রোগ জটিলতা সৃষ্টি তো করেই, এমনকি এটি মৃত্যুর কারণও হতে পারে।
অস্টিওপোরোসিস কী?
অস্টিওপোরোসিস শব্দটির অর্থই হলো ছিদ্রযুক্ত হাড়। এই রোগে হাড় ধীরে ধীরে দুর্বল হতে শুরু করে, এবং শেষপর্যন্ত ক্ষয় হয়ে একসময় ভেঙ্গেও যেতে পারে। আর এই রোগে ভোগা দেহের হাড় সাধারণ হাড়ের মতো স্বাভাবিক নিয়মে জোড়া লাগে না। একসময় হাড়গুলো দেহের ভারও বহন করতে পারে না। সামান্য আঘাতেই ভেঙ্গে যায় হাড়।
কীভাবে এ রোগ দেহে বাসা বাঁধে?
বিশেষজ্ঞদের গবেষণায় অস্টিওপোরোসিসের পেছনে বেশ কয়েকটি কারণ জানা গেছে। প্রথমত, ক্যালসিয়ামের অভাবে হাড় ঠিকমতো গঠিত হতে না পারলে পরবর্তীতে এই রোগের ঝুঁকি বেড়ে যায়। এছাড়া বয়স বাড়ার সাথে সাথে হাড় ক্ষয় হলেও সে অনুপাতে আবার ক্ষয়পূরণ হয় না। তাই মধ্যবয়স্ক নারী ও পুরুষদের মাঝেই এই রোগ বেশি দেখা যায়। মেনোপজের পর নারীদের এস্ট্রোজেন উৎপাদন বন্ধ হওয়ার পর এই রোগের ঝুঁকি অনেক বেশিমাত্রায় বাড়তে থাকে। স্টেরয়েড-ভিত্তিক ও অন্যান্য হরমোন-প্রভাবক ঔষধের প্রভাবেও এই রোগ হতে পারে। শারীরিকভাবে যারা কম সক্রিয় থাকেন এবং অতিমাত্রায় ধূমপান ও এলকোহল সেবন করেন, তাদের এই রোগের ঝুঁকি অনেক বেশি। এই রোগের ঝুঁকি জিনগতভাবেও প্রবাহিত হয়।
সাবধান হবেন যে কারণে
⦁ অস্টিওপোরোসিস কোন সাময়িক রোগ নয়। ঠিক সময়ে চিকিৎসা না নিলে ও সচেতন না হলে এই রোগ ভোগাবে অনেক দিন, এবং প্রবল যন্ত্রণার কারণ হয়েও দাঁড়াবে।
⦁ এতে হাড় দুর্বল হয়ে পড়ে এবং অল্প চাপেই কোমর, বুক কিংবা কবজির হাড় ভেঙ্গে যেতে পারে।
⦁ এই রোগে আক্রান্ত হাড় ভেঙ্গে গেলে সহজে জোড়া লাগে না। ফলে শয্যাশায়ী হয়ে থাকতে হবে দীর্ঘসময়।
⦁ দীর্ঘসময় শারীরিকভাবে অচল থাকায় রক্ত জমাট বাঁধা, ফুসফুসীয় এমবোলিজম কিংবা শরীরের রক্ত সঞ্চালন প্রক্রিয়ায় অসুবিধাসহ নানা সমস্যা প্রকট আকার ধারণ করে। তা একসময় মৃত্যুর কারণ হয়েও দাঁড়ায়।
⦁ মেনোপজের পর এস্ট্রোজেন উৎপাদন বন্ধ হয়ে যায় বলে মধ্যবয়সী নারীদের এই রোগের ব্যাপারে বিশেষভাবে সচেতন হতে হবে।
প্রতিরোধ করবেন যেভাবে
বর্তমানে অস্টিওপোরোসিসের বিভিন্ন চিকিৎসা বের হলেও, সঠিক সময়ে ধরা না পড়া এই রোগের প্রধান সমস্যা। তাই সবার, বিশেষত নারীদের অস্টিওপোরোসিসের পরীক্ষা সঠিক সময়ে করা দরকার। আর নিয়মিত ঔষধ সেবনের মাধ্যমে এই রোগ নিয়ন্ত্রণে রাখা যায়। পাশাপাশি খাদ্য ও জীবনযাত্রায় আনতে হবে পরিবর্তন।
খাদ্যাভ্যাস দিয়ে যেভাবে ক্ষয় রুখে দিবেন
অস্টিওপোরোসিস রোগটিতে আক্রান্ত হওয়ার পর প্রতিকারের আগে প্রতিরোধের ব্যবস্থা নেয়া অনেক বেশি শ্রেয়। এই রোগের ঝুঁকিতে থাকলে খাদ্যাভ্যাসে পরিবর্তন আনতে হবে।
ক্যালসিয়াম ও ভিটামিন ডি এই রোগ প্রতিরোধে সবচেয়ে বেশি ভূমিকা রাখে। আর এজন্য যা খেতে হবে তা হলো-
দুগ্ধজাত খাবার: দুধ, দই, ছানা, পনির।
সবুজ শাকসবজি: সরিষা শাক, বাঁধাকপি, ব্রকোলি, কচুশাক, সজনেপাতা ইত্যাদিতে প্রচুর পরিমাণে ক্যালসিয়াম থাকে।
সামুদ্রিক মাছ: স্যালমন, কোরাল, লইট্যা ইত্যাদি মাছ ভিটামিন ডি ও ক্যালসিয়ামে সমৃদ্ধ।
শুকনো ফল: ডুমুর, খেজুর ইত্যাদি ফলে ক্যালসিয়ামের পাশাপাশি ম্যাগনেসিয়াম ও পটাশিয়ামও থাকে। এ উপাদানগুলো দেহে ক্যালসিয়ামের ভারসাম্য রক্ষা করে।
কাঠবাদাম: কাঠবাদামে ক্যালসিয়ামের পাশাপাশি পটাশিয়ামও থাকে, যা দেহকে ক্যালসিয়াম শোষণ করতে সহায়তা করে। এছাড়া এর প্রোটিন ও অন্যান্য পুষ্টিগুণ সবল হাড় গঠনে সাহায্য করে।
তবে কিছু কিছু উপাদান যেমন ফাইটিক এসিড, অক্সালিক এসিড, সোডিয়াম ইত্যাদি দেহের ক্যালসিয়াম শোষণে বাধা দেয়। তাই বিভিন্ন ডাল ও শস্যজাতীয় খাবার, পালং শাক ও লবণযুক্ত খাবার খেতে হবে সাবধানে।
৯টি খাবার থেকে বেঁচে থাকুন
কোন ধরনের খাবার আমাদের শরীরের হাড়কে ভাল রাখে এবং শক্তিশালী করে এটা জানা যেমন জরুরী, তেমনি এটা জানাও সমান গুরুত্বপূর্ণ যে কোন ধরনের খাবার আপনার কিচেন ক্যাবিনেটে থাকবে না। সোজা কথায়, কোন ধরনের খাবার আপনি খাবেন না। তাই নিম্নোক্ত খাবারের ব্যাপারে সাবধান থাকতে হবে।
১। হাই সোডিয়াম সমৃদ্ধ খাবার
যত বেশি লবণ খাবেন, তত বেশি ক্যালসিয়াম আপনি শরীর থেকে হারাবেন। কলম্বিয়া ইউনিভার্সিটির এন্ডোক্রাইনোলজিস্ট ও আমেরিকার জাতীয় অস্টিওপোরোসিস ফাউন্ডেশনের মুখপাত্র অধ্যাপক ফেলিসিয়া কসম্যান বলেন, এটা সবার জানা থাকা উচিত যে অতিরিক্ত লবণ খেলে কিডনী দিয়ে ক্যালসিয়াম বেরিয়ে যায়। ডা. কসম্যান হাড়ের সর্বোচ্চ সুস্থতার জন্য সীমিত পর্যায়ে লবণ খেতে বলেন। তার মতে, দৈনিক ২.৩ গ্রামের চেয়ে কম লবণ খাওয়া উচিত। বেশ কিছু দিন আগে আমেরিকার স্বাস্থ্য বিভাগ এই বলে সবাইকে সতর্ক করে যে, যাদের অন্যান্য সমস্যা আছে যেমনঃ হাই ব্লাড প্রেশার, ডায়াবেটিস, কিডনীর সমস্যা ইত্যাদি, তাদের অবশ্যই অল্প লবণ খাওয়া উচিত।
২। মিষ্টি জাতীয় খাবার
এটা আপনাকে সব সময় মনে রাখতে হবে যে অতিরিক্ত চিনি শরীরের জন্য কখনই ভাল নয়। আমেরিকার জাতীয় অস্টিওপোরোসিস ফাউন্ডেশনের ট্রাস্টি ও নিউইয়র্কের মহিলা ক্রীড়া চিকিৎসার স্পেশাল সার্জারি বিভাগের সিনিয়র পুষ্টিবিদ হেইডি স্কলনিক বলেন, যদিও চিনি ও হাড়ের উপর এর নেগেটিভ প্রভাব কোন প্রমাণিত গবেষণা নেই, তবে অতিরিক্ত চিনি খাওয়ার কারণে হাড়ের ক্ষয় ত্বরান্বিত হয় এবং হাড় তার সুস্থতার জন্য যথেষ্ট পরিমানে পুষ্টি উপাদান পায় না।
৩। সোডা
অতিরিক্ত সোডা খাওয়ার ফলে আপনার হাড়ে খারাপ প্রভাব পড়তে পারে। আমেরিকার জাতীয় অস্টিওপোরোসিস ফাউন্ডেশনের মুখপাত্র অধ্যাপক ফেলিসিয়া কসম্যান বলেন, সপ্তাহে সাতটি বা তার চেয়ে বেশি সোডার ক্যান খেলে হাড়ের মিনারেলের ঘনত্ব কমে যায় ও হাড় ভেঙ্গে যাওয়ার আশংকা বৃদ্ধি পায়। এটা ঠিক পরিষ্কার নয়, তবে অতিরিক্ত সোডা কোনভাবেই সাধারণ শরীরের জন ভাল নয়।
প্রায় ৭৩০০০ মহিলা যাদের কোন কারণে মাসিক বন্ধ হয়ে গেছে, এদের উপরে একটি সার্ভে করা হয়। আমেরিকার জার্নাল অফ ক্লিনিক্যাল নিউট্রিশন এর একটি প্রকাশনায় সার্ভেটি প্রকাশিত হয় ২০১৪ সালে। এতে দেখা যায়, যেসব মাসিক বন্ধ হওয়া মহিলারা বেশি সোডা খান, সেটা নর্মাল বা ডায়েট হোক, কোলা না নন-কোলা হোক, ক্যাফেইনসহ বা ক্যাফেইন ছাড়া হোক, তাদের হিপে (পশ্চাদদেশে) ক্ষয় বা ভাঙ্গন হওয়ার প্রবণতা বেশি। এতে আরো বলা হয়, সোডা যত বেশি খাওয়া হবে, ঝুঁকি তত বেশি হবে।
৪। ক্যাফেইন
যে সব মহিলারা (যাদের মাসিক নানা কারণে বন্ধ) ক্যাফেইন খেতে ভালবাসেন, তারা ২০১৬ সালে অক্টোবর মাসে প্রকাশিত বিএমসি মাস্কুলোসকেলিটাল ডিসঅর্ডার ম্যাগাজিনের হাড়ের উপর ক্যাফেইনের বাজে প্রভাব (হাড়ের ঘনত্ব কমে যাওয়া) নিয়ে প্রকাশিত প্রবন্ধটি পড়ে দেখতে পারেন। নিউইয়র্কের একজন প্রখ্যাত পুষ্টি বিষয়ক পরামর্শক ডিনা খাদের বলেন, ক্যাফেইন হাড় থেকে ক্যালসিয়াম শুষে নেয়, হাড়ের দৃঢ়টা কমিয়ে দেয়। শুধু তাই নয়। আসলে ১০০ মিলিগ্রাম ক্যাফেইন খেলে ৬ মিলিগ্রাম ক্যালসিয়াম নষ্ট হয়।
৫। বীজ জাতীয় খাবার
বীজ বা বীন জাতীয় খাবার শরীরকে ক্যালসিয়াম শুষে নিতে বাঁধা দেয়। বিভিন্ন ধরনের বীজ বা ডালের মধ্যে ফাইলেটস নামে একটি উপাদান থাকে। এন্ডোক্রাইনোলজিস্ট ও আমেরিকার জাতীয় অস্টিওপোরোসিস ফাউন্ডেশনের মুখপাত্র অধ্যাপক ফেলিসিয়া কসম্যান বলেন, ফাইলেটস এর অতিরিক্ত উপস্থিতির ফলে হাড়ে ক্যালসিয়াম এর পরিমাণ কমে যায়। তবে বীজ বা বীন জাতীয় খাবার জাতীয় খাবারে ম্যাগনেশিয়াম, ফাইবার ও অন্যান্য পুষ্টিকর উপাদান আছে যা অস্টিওপোরোসিস ও সার্বিক ভাবে শরীরের জন্য ভাল। তাই বীজ বা বীন জাতীয় খাবার খাবার বাদ না দিয়ে ভাল মত পানিতে ঘণ্টা দুই ভিজিয়ে রেখে ধুয়ে রান্না করলে ফাইলেটস এর পরিমাণ কমে যাবে।
৭। প্রদাহজনিত খাবার
আমেরিকার প্রখ্যাত পুষ্টি বিষয়ক পরামর্শক ডিনা খাদের বলেন, টম্যাটো, মাশরুম, সাদা আলু ইত্যাদি হাড়ের প্রদাহ বাড়ায় যা অস্টিওপোরোসিস এর দিকে যেতে পারে। তবে এসব খাবারের মধ্যে ভিটামিন ও মিনারেলস আছে, যা শরীরের জন্য উপকারী । তাই এসব খাবার বাদ না দিয়ে সীমিত পরিমানে খাওয়া যেতে পারে। অধ্যাপক ফেলিসিয়া কসম্যান এর মতে, দৈনিক ১০০০ থেকে ১২০০ মিলিগ্রাম এর মত এসব খাবার খাওয়া যেতে পারে এবং এতে হাড় ভাল থাকবে।
৮। সবুজ পাতা ও শাঁক-সব্জি
সবুজ পাতা ও শাঁক-সব্জিতে হাড়ের জন্য উপকারী ক্যালসিয়াম আছে, কিন্তু এসব খাবারে আবার অক্সালেটস নামে একটি উপাদানও আছে যা ক্যালসিয়াম এর সাথে মিশে একে শরীরের জন্য অনুপযোগী করে দেয়। তাই এসব তরকারী জাতীয় খাবার থেকে উপকার পেতে এবং অস্টিওপোরোসিস থেকে বেঁচে থাকতে হলে অধ্যাপক ফেলিসিয়া কসম্যান এর মতে, যেসব খাবার থেকে শরীরে ক্যালসিয়াম সরাসরি চলে যায়, সেসব খাবার ব্যাল্যান্স করে অন্যান্য খাবারের সাথে মিশিয়ে খেতে হবে। যেমনঃ শাঁক-সবজির সাথে চীজ মিশিয়ে খাওয়া উচিত।
৯। প্রসেস করা মাংস
পুষ্টি বিষয়ক পরামর্শক ডিনা খাদের বলেন, অতিরিক্ত প্রসেস করা মাংস বা প্রাণীজ প্রোটিন শরীরে থাকলে তা হাড়ে ক্যালসিয়াম এর পরিমাণ কমিয়ে দেয়। তাই যাদের অস্টিওপোরোসিস আছে বা হওয়ার সম্ভাবনা আছে, তাদের সপ্তাহে ৪ থেকে ৬ আউন্স মাংস খাওয়া উচিত।
২০১৭ সালে জানুয়ারীতে অ্যাডভানস ইন নিউট্রিশনের একটি গবেষণায় দেখা যায় যে, প্রসেস করা মাংস, সফট ড্রিঙ্কস, তেলে ভাঁজা খাবার, মিষ্টি ইত্যাদি খাবার খাওয়া কমিয়ে দিলে তা হাড়ের জন্য উপকার বয়ে আনে। অস্টিওপোরোসিস থেকে বেঁচে থাকার জন্য প্রচুর ফল ও শাক-সব্জি এবং কম ফ্যাট ওয়ালা দুধ, মাছ, মুরগী খেতে হবে। খেতে হবে বাদাম, বীজ জাতীয় খাবার ও ক্যাফেইন ছাড়া কফি। এড়িয়ে চলতে হবে চিনি জাতীয়, চকোলেট ও ক্যাফেইন সমৃদ্ধ খাবার। বর্তমান কালের গবেষণা একথা গুলোর প্রতিধ্বনি করে।
আরো যেসব অভ্যাস চাই
অস্টিওপোরোসিস রোগটি বাসা বাঁধলে তা শুরুতেই টের পাওয়া যায় না। তাই খাবারের ব্যাপারে সচেতনতার পাশাপাশি ধূমপান কিংবা এলকোহল বাদ দিতে হবে। এছাড়া পর্যাপ্ত পরিমাণে সূর্যের আলোর সংস্পর্শে আসার জন্য দিনের বেলা বাইরে কিছুটা সময় কাটাতে হবে।